আলোকিত মানুষ তৈরির প্রধান কারিগর শিক্ষক সমাজ। বাবা-মা ও পরিবেশ শিক্ষার সহায়ক শক্তি হিসেবে কাজ করে থাকে। শিশুর প্রথম শিক্ষক তারা। তাদের পাশাপাশি শিক্ষক গড়ে তোলেন আলোকিত মানুষ। এ মানুষগুলোই আলো ছড়ান সমাজ, দেশ ও বিদেশে। এ আলোয় আলোকিত হয়ে গড়ে ওঠে উন্নত বিশ্ব। তাই বলা হয়ে থাকে শিক্ষা জাতির মেরুদণ্ড। জাতির মেরুদণ্ড শিক্ষাকে সচল রাখার অভিপ্রায় কাজ করে থাকেন শিক্ষক।
উন্নত দেশ তথা স্মার্ট বাংলাদেশ গড়ে তুলতে মুখ্য ভূমিকা পালন করতে হবে শিক্ষক সমাজকে। এই গুরুদায়িত্ব পালন করতে হলে সর্বাগ্রে মেরুদণ্ড সচল রাখতে হবে শিক্ষকদের। দুর্নীতিমুক্ত শিক্ষাব্যবস্থার পাশাপাশি শিক্ষকদের অভিন্ন মর্যাদা ও বেতনের বিষয়টি সংশ্লিষ্টদের গুরুত্বের সঙ্গে আমলে নিতে হবে। পিতা-মাতা যেমন সন্তানের গুরুজন, তেমনি রাষ্ট্রের সব পর্যায়ের শিক্ষিত নাগরিকও শিক্ষকদের সন্তান। শিক্ষকরা হলেন পরম শ্রদ্ধেয় গুরুজন। তারা সচিব, মন্ত্রী এমনকি বিচারপতি, প্রধানমন্ত্রী ও রাষ্ট্রপতি গড়ার কারিগরও বটে। শিক্ষক সমাজকে নিয়ে সংশ্লিষ্টদের বিকৃত তথা অসুস্থ মানসিকতা পরিহার করতে হবে। পিতা-মাতা সন্তান জন্ম দেয়। শিক্ষক তাদের সন্তানদের পরিপূর্ণ মানুষ হিসেবে তৈরি করে থাকেন। বর্তমান আইনে সন্তানদের ওপর যেমন পিতা-মাতার ভরণপোষণের দায়িত্ব অর্পণ করা হয়েছে, তেমনি শিক্ষকদের সন্তান হিসেবে নাগরিক তথা রাষ্ট্রকেও শিক্ষকদের সার্বিক দায়িত্ব বহন করা প্রয়োজন। শিক্ষকদের নিয়ে রাষ্ট্রের দৃষ্টিভঙ্গিতে বৈষম্য থাকা কাম্য নয়। শিক্ষকদের মর্যাদা থার্ড ও সেকেন্ড ক্লাস। এ লজ্জা সমাজ বা রাষ্ট্রের। রাষ্ট্র তাদের গুরুজনকে পদ মর্যাদায় অবহেলিত রাখবেন, এ অসম্মান কাম্য হতে পারে না।
শিক্ষকরা সর্বাধিক সম্মানের পাত্র। হোক তারা ইবতেদায়ি মাদরাসা, প্রাথমিক, উচ্চ বিদ্যালয়, কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ের। তাদের সবার মর্যাদা থাকবে প্রথম শ্রেণির। শিক্ষকদের কর্মচারীর ভাবনায় দেখাও রাখা মোটেই বাঞ্ছনীয় নয়। জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের মাঝে এই ভাবনার দৃশ্যমান ছিলো। তারই সুযোগ্য কন্যা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার মধ্যেও এই ভাবনা পরিলক্ষিত হলেও, পারিপার্শ্বিক পরিবেশে এর বিকাশ খুবই ধীর। শিক্ষকদের নিয়ে এ ভাবনা আমলাতান্ত্রিক জটিলতায় মাঝে মাঝে চ্যালেঞ্জের মুখে পড়ে। বঙ্গবন্ধু স্বাধীনতার ঊষালগ্নে চরম অভাবের মধ্যে ৩৭ হাজার প্রাথমিক বিদ্যালয় জাতীয়করণ করেছিলেন। তারই আদর্শে অনুপ্রাণিত হয়ে ২০১৩ খ্রিষ্টাব্দে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ২৬ হাজার ১৯৩টি প্রাথমিক বিদ্যালয় জাতীয়করণ করেছিলেন। অথচ আমলাতান্ত্রিক জটিলতার কষাঘাতে সাবেক প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রী মোস্তাফিজুর রহমানের আমলে যাচাই-বাছাই করে যোগ্য হওয়া সত্ত্বেও আজো ৪৪টি বেসরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় জাতীয়করণ করা হয়নি। অথচ ৪৪টি বেসরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় জাতীয়করণকৃত হিসেবে গণ্য করেই ২৬ হাজার ১৯৩টি সরকারিভাবে প্রচার করা হয়ে থাকে। এভাবে বিভিন্নভাবে সংশ্লিষ্টরা শিক্ষা তথা শিক্ষকের প্রতি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার আন্তরিকতা প্রশ্নবিদ্ধ করে রেখেছেন।
প্রধানমন্ত্রী বারবার শিশুদের লেখাপড়ার পাশাপাশি খেলাধুলাও বিনোদনের ওপর গুরুত্ব দিয়ে যাচ্ছেন। অথচ সংশ্লিষ্ট বিদ্যালয়ের সময়সূচিকে খেলাধুলা বিনোদনবান্ধব না করে শিশুর অধিকার হরণ করে চলেছেন। গত ১৭ মার্চ গোপালগঞ্জের টুঙ্গিপাড়ায় শিশু দিবস উপলক্ষে আয়োজিত শিশুর সমাবেশে প্রধানমন্ত্রী শিক্ষার্থীদের ওপর অতিরিক্ত চাপ না দিতে অভিভাবক ও শিক্ষকদের প্রতি আহ্বান জানিয়ে বলেন, লেখাপড়া খুবই দরকার কিন্তু লেখাপড়ার নামে তাদের ওপর কোনো চাপ সৃষ্টি করবেন না। খেলাধুলা ও নানা সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডের মধ্য দিয়ে যেনো তারা লেখাপড়া শিখতে পারেন, যাতে তাদের সুপ্ত প্রতিভা ও মেধাবিকাশের সুযোগ সৃষ্টি হয়। সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সময়সূচি ও চতুর্থ-পঞ্চম শ্রেণির মূল্যায়নের নামে পূর্বের মতো পরীক্ষা ব্যবস্থাসহ শিশু শিক্ষার্থীদের ওপর চাপ সৃষ্টি করা প্রধানমন্ত্রীর বক্তব্যের সঙ্গে সাংঘর্ষিক। শিশুশিক্ষার্থীর খেলাধুলা ও সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডের মাধ্যমে তাদের লেখাপড়া নিশ্চিত করার লক্ষে দুপুর দুইটার মধ্যে তাদের বিদ্যালয়ের কার্যক্রম সমাপ্ত করা প্রয়োজন। এর ফলে শিক্ষার্থীরা দুপুরে হাত, মুখ, শরীর ভালোভাবে ধুয়ে বা গোসল করে গরম ভাত খেতে পারেন। খানিকটা বিশ্রাম বা ঘুমিয়ে বিকেলে সুস্থ দেহ মন নিয়ে ফুরফুরে শরীরে ক্লান্তিহীনভাবে খেলাধুলা বা বিনোদনে শরিক হতে পারেন। ২০ থেকে ৪৫ মিনিটের শ্রেণির কার্যক্রম পরিহার করে প্রতিটি পিরিয়ডের সময়সূচি ১ ঘণ্টা করা প্রয়োজন। দৈনিক চারটা পিরিয়ডের বেশি হওয়া কাম্য নয়।
দৈনিক ক্লাসের সংখ্যা বেশি হলে শিক্ষক শিক্ষার্থীদের শিখন ঘাটতি দূর করতে চ্যালেঞ্জ হবে। শিক্ষকদের মর্যাদা ও বেতন যথাযথ ব্যবস্থা করে শিখন ঘাটতির ওপর কঠোর জবাবদিহিতা নিশ্চিত করা প্রয়োজন। বর্তমানে প্রত্যেক শ্রেণিতে দৈনিক ছয় থেকে সাতটি স্বল্প সময়ের শ্রেণির কার্যক্রম বন্ধ করতে হবে। এর ফলে শিক্ষার্থীর ওপর বাড়িতে পড়ার চাপ কমবে। এতে প্রধানমন্ত্রীর চাপমুক্ত আনন্দদায়ক পরিবেশে খেলাধুলার সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডসহ বিনোদনের মাধ্যমে লেখাপড়া নিশ্চিত হবে। শিক্ষাক্ষেত্রে সব বৈষম্য শূন্যে নামিয়ে আনতে হবে। থাকবে না এমপিও, নন-এমপিও, সরকারি-বেসরকারি শিক্ষাব্যবস্থা। শিক্ষাব্যবস্থা থাকবে এক ও অভিন্ন। প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশনা মোতাবেক প্রথম থেকে তৃতীয় শ্রেণিতে আদি পরীক্ষা পদ্ধতি বিলুপ্ত করে চালু হয়েছে, ধারাবাহিক মূল্যায়ন ব্যবস্থা। এ মূল্যায়ন প্রক্রিয়ায় অংশগ্রহণ করছেন শুধুমাত্র সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা। সরকারি-বেসরকারি উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রাথমিক শাখা, কিন্ডারগার্টেন বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের মাঝে এর কোনো ছোঁয়া লাগেনি। স্বাধীন দেশে একই শিক্ষাক্রমে প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশনা অমান্য করে নিজেদের খেয়াল খুশি মতো চলছে এসব শিশুশিক্ষা। বাস্তবে প্রাথমিকের বিজ্ঞ কর্মকর্তারা মন্ত্রণালয় তথা মহাপরিচালকের অধিদপ্তরের নীতিনির্ধারণী পর্যায়ে শিক্ষা পরিচালনা করে চলেছেন, তাদের অভিজ্ঞতা ও দৃষ্টিভঙ্গি দিয়ে।
শিশুশিক্ষা নিয়ে তারা তৃণমূলের অভিজ্ঞতায়সমৃদ্ধ হয়ে কাজ করে বেড়ে ওঠেনি। প্রত্যেক পেশার মন্ত্রণালয় যেমন শিক্ষা, কৃষি, স্বাস্থ্য, পশুপাখিসহ প্রায় সব মন্ত্রণালয়ের নীতি-নির্ধারণী পর্যায়ের কর্মকর্তা তৃণমূলের অভিজ্ঞতা নিয়ে কাজ করে আসছেন।
বাংলাদেশের সবচেয়ে বৃহৎ জনবলের মন্ত্রণালয় প্রাথমিক ও গণশিক্ষা। অথচ এই মন্ত্রণালয়ে তৃণমূলের অভিজ্ঞতাসমৃদ্ধ নীতিনির্ধারণী পর্যায়ে জনবল একেবারেই শূন্য। এর কারণ এই বিশাল মন্ত্রণালয়ের নেই কোনো নিজস্ব ক্যাডার সার্ভিস। স্মার্ট বাংলাদেশের স্বপ্ন বাস্তবায়নে আলোকিত মানুষ তৈরিতে সর্বাগ্রে নিয়ে প্রয়োজন দক্ষ ও অভিজ্ঞ জনবল। এই সমৃদ্ধ জনবল সৃষ্টিতে প্রয়োজন প্রাথমিকের সহকারী শিক্ষক পদকে এন্ট্রি ধরে সর্বোচ্চ নীতিনির্ধারণী পর্যায়ে মেধাবী, অভিজ্ঞদের শতভাগ পদোন্নতির মাধ্যমে নিয়ে আসা। শিক্ষকরা দেশ ও জাতির সম্মানিত ব্যক্তি। তাদের সম্মান অক্ষুন্ন রাখার প্রয়াসে প্রাথমিক শিক্ষায় স্বতন্ত্র ক্যাডার সার্ভিস সৃষ্টির মাধ্যমে শিক্ষকদের বস হবেন শিক্ষকরা। প্রাথমিকের স্বতন্ত্র ক্যাডার সার্ভিস সৃষ্টির মাধ্যমে প্রাথমিক শিক্ষার নীতিনির্ধারণী পর্যায়ে থাকবে মেধাবী ও অভিজ্ঞ জনবল। এতে প্রধানমন্ত্রী স্মার্ট বাংলাদেশের স্বপ্ন ত্বরান্বিত হবে। গড়ে উঠবে স্মার্ট বাংলাদেশের স্বপ্ন পূরণে আলোকিত মানুষ।
লেখক: সভাপতি, বঙ্গবন্ধু প্রাথমিক শিক্ষা গবেষণা পরিষদ