স্যার সম্বোধন ক্ষমতায়নকে স্বীকৃতি দেয় না বৈষম্যকে উস্কে দেয় - দৈনিকশিক্ষা

স্যার সম্বোধন ক্ষমতায়নকে স্বীকৃতি দেয় না বৈষম্যকে উস্কে দেয়

দৈনিক শিক্ষাডটকম ডেস্ক |

কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বলেছেন, “লুকালে ব’লেই খুঁজে বাহির করা, ধরা যদি দিতে তবে যেত না ধরা\ পাওয়া ধন আনমনে হারাই যে অযতনে, হারাধন পেলে সে যে হৃদয়-ভরা\” শতবর্ষ পূর্বে কবিগুরু অর্জন-বিসর্জন ও পুনঃপ্রাপ্তির মূল্যায়নে যেভাবে মানুষের স্বরূপ উন্মোচন করেছেন, বর্তমান সময়েও সেই মূল্যায়ন বা মানসিক বৈশিষ্ট্যের তারতম্য নেই। লাখো প্রাণের বিনিময়ে অর্জিত স্বাধীনতার মূল আদর্শ অসাম্প্রদায়িকতা, বৈষম্য ও শোষণ-বঞ্চনামুক্ত ন্যায্যতার রাষ্ট্র কাঠামো স্বাধীনতার ৫৪ বছরে আনমনে-অযতনে নষ্ট করা হয়েছে। এখন অযতনে হারানো গৌরব ফিরে পেলে আমাদের হৃদয় মন প্রাপ্তির আনন্দে ভরে যাবে। তা সত্ত্বেও বলতে হয়, ন্যায় ও সাম্যের বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠায় জাতি কতটুকু সফল হয়েছে, তা নিয়ে রয়েছে নানামুখী বিতর্ক ও প্রশ্ন। বঙ্গবন্ধু দ্ব্যর্থহীন কণ্ঠে বলেছিলেন, বিশ্ব আজ দুভাগে বিভক্ত-শোষক ও শোষিত, আমি শোষিতের পক্ষে। বঙ্গবন্ধুর এই আদর্শিক দর্শনে কি জাতি ধাবিত? । সোমবার (২০মে) ভোরের কাগজ  পত্রিকায় প্রকাশিত এক নিবন্ধে এ তথ্য জানা যায়।

বিগত ২০০ বছরের ইতিহাসে বাঙালি জাতির সর্বশ্রেষ্ঠ অর্জন স্বাধীন-সার্বভৌম বাংলাদেশ। দারিদ্র্যমুক্ত বৈষম্যহীন সোনার বাংলা গড়ার স্বপ্ন দেখেছিলেন জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। স্বাধীনতার ৫৪ বছর পেরিয়ে সে স্বপ্ন আজো অধরা রয়ে গেছে। রক্তক্ষয়ী মুক্তিযুদ্ধে অর্জিত ১৯৭১ খ্রিষ্টাব্দে শ্রেষ্ঠ অর্জন স্বাধীনতার মূলে লুকায়িত সোনার বাংলা কি আমরা আনমনে অযতনে হারিয়েছি? নাকি তা অনাদরে লুকিয়ে রয়েছে মেঘের কোলে?

দেশ-বিদেশে অবস্থানরত মহাজ্ঞানী মহাজনরা বঙ্গবন্ধুর সেই প্রত্যাশিত সোনার বাংলা খুঁজে পাওয়ার চেষ্টায় নিয়োজিত না থাকলেও নিশ্চিতভাবেই বলা যায়- বঙ্গবন্ধুর আত্মজা শেখ হাসিনা সেই পথের সন্ধান করছেন নিরন্তন নিরবধি। জাতির অংশ হিসেবে দেশপ্রেমিক সবাই বঙ্গবন্ধুর বহুল কাক্সিক্ষত সোনার বাংলা নির্মাণে প্রধানমন্ত্রীর আরোধ্য যাত্রায় মহান মুক্তিযুদ্ধ ও স্বাধীনতার চেতনায় ঐক্যবদ্ধ হওয়ার ব্যতীত বিকল্প নেই। সেই ঐক্যবদ্ধ প্রচেষ্টায় আমাদের ভাবতে হবে বঙ্গবন্ধুর অনুপস্থিতিতে কী কারণে জাতি অভীষ্ট লক্ষ্যে পৌঁছাতে পারেনি। কোন কোন ভাইরাস জাতিকে দ্বিধাবিভক্ত করছে?

শত বছরের শোষণ শাসন প্রক্রিয়ায় মনু প্রবর্তিত ব্রাহ্মণ, ক্ষত্রিয়, বৈশ্য ও শুভ্র স্বাধীন জন্মভূমির সমাজরাষ্ট্রের পরতে পরতে বিদ্যমান। যা আমাদের রাষ্ট্রব্যবস্থায় ক্যাডার, নন-ক্যাডার এবং প্রথম শ্রেণি, দ্বিতীয় শ্রেণি, তৃতীয় শ্রেণি ও চতুর্থ শ্রেণি হিসেবে আভিজাত্য বা কৌলিন্যবোধের ভিত সৃষ্টি করেছে। সেই শ্রেণি বিভক্তি ও বৈষম্যের বর্ণবাদ ঐক্যবদ্ধ জাতি গঠন প্রক্রিয়ায় মূল প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করছে। যা স্বপ্নের সোনালি যাত্রার প্রধান অন্তরায়।

ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শাসন পদ্ধতি দক্ষিণ এশিয়ায় শুধু ভাষা ও শিরোনামের ক্ষেত্রে নয়, শাসনব্যবস্থার গভীরে নানাভাবে বৈষম্যমূলক প্রভাব আজো সমাজে বিদ্যমান। রাজকর্মচারীদের স্যার সম্বোধন তারই একটি অপদৃষ্টান্ত। ব্রিটিশ রাজতন্ত্র দ্বারা নাইট উপাধিপ্রাপ্ত ব্যক্তিদের সম্বোধন করতে ব্যবহৃত স্যার শব্দটি প্রতিপত্তি ও কর্তৃত্বের একটি প্রতীক। দক্ষিণ এশিয়ায় সম্মানসূচক ‘স্যার’-এর ব্যবহারের সঙ্গে ঔপনিবেশিক ইতিহাস, সামাজিক স্তরবিন্যাস ও সাংস্কৃতিক সূ²তার একটি জটিল অন্তক্রিয়া রয়েছে। স্যার শব্দটি সম্মানের শব্দ হিসেবে গণ্য করা হলেও এর বাহ্যিক ব্যবহারে একটা কৌলিন্য ও আভিজাত্যবোধের প্রক্রিয়া জড়িয়ে রয়েছে। মূলত ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক যুগে প্রবর্তিত ‘স্যার’ উপাধিটি নাইটহুড বা আভিজাত্যের প্রাথমিক অর্থকে অতিক্রম করেছে এবং ভারত, বাংলাদেশ ও পাকিস্তানের মতো দেশের সামাজিক কাঠামোর মধ্যে এটিকে ধারণ করা হয়েছে। এই গ্রহণ ও অভিযোজন ঔপনিবেশিক গতিশীলতাকে প্রতিফলিত করে এবং এ অঞ্চলের সামাজিক-সাংস্কৃতিক পরিমণ্ডলের অন্তর্দৃষ্টি প্রদান করে। যেহেতু ঔপনিবেশিক প্রশাসন সামাজিক প্রতিপত্তি ও পেশাগত সাফল্যের মান নির্ধারণ করে, সঙ্গতই স্যারের মতো উপাধিগুলো অভিজাত মর্যাদার প্রতীক হয়ে উঠে এবং প্রায়ই ঔপনিবেশিক কাঠামোর মধ্যে শিক্ষা, সম্পদ বা প্রতিপত্তি প্রভাবে সঙ্গে যুক্ত হয়।

স্বাধীন বাংলাদেশের সংবিধানের প্রথম ভাগে ৭-এর (১) ধারায় বলা হয়েছে, ‘প্রজাতন্ত্রের সকল ক্ষমতার মালিক জনগণ, এবং জনগণের পক্ষে সেই ক্ষমতার প্রয়োগ কেবল এই সংবিধানের অধীন ও কর্তৃত্বে কার্যকর হইবে।’ এ ধারাবলে সংবিধানে জনগণের সার্বভৌমত্ব, সুপ্রিমেসি ও অধিকার উচ্চকিত হয়েছে। বঙ্গবন্ধু প্রণীত গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের সংবিধান গণতন্ত্র, সাম্য ও ন্যায়বিচারের অকাট্য দলিল হিসেবে বিবেচনা করা হয়। যেখানে সব ধরনের শোষণ ও ঔপনিবেশিক কর্তৃত্ববাদকে প্রত্যাখ্যান করা হয়েছে। স্বাধীনতার ৫ দশক পরে এসে এই জনসুপ্রিমেসি কতটা প্রতিষ্ঠা পেয়েছে, সেটা সঙ্গত কারণে জনমনে প্রশ্নের উদ্বেগ ঘটাতে পারে। উন্নত ও সভ্য রাষ্ট্রে সরকারি কর্মচারীরা সেবা গ্রহণকারী নাগরিকদের স্যার বলে সম্বোধন করেন। এটাই সঙ্গত। কারণ জনগণের করের অর্থে গণকর্মচারীরা বেতন-ভাতাদি পেয়ে থাকেন। অথচ বাংলাদেশে সংবিধানে জনসার্বভৌমত্ব উপেক্ষা করে এখন জনগণকেই প্রজাতন্ত্রের কর্মচারীদের স্যার সম্বোধন করতে হচ্ছে। যা পশ্চাৎ ধ্যান-ধারণা ও ঔপনিবেশিক শোষক-শোষণের দৃষ্টিভঙ্গির প্রতিফলন মাত্র।

গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের সংবিধানের ১৫২ অনুচ্ছেদে ‘সরকারি কর্মচারী’ অর্থ প্রজাতন্ত্রের কর্মে বেতনাদি যুক্ত পদে অধিষ্ঠিত কর্মরত কোনো ব্যক্তি উল্লেখ করা হয়েছে। আর সংবিধানের ২১(২) অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে- সকল সময়ে জনগণের সেবা করিবার চেষ্টা করা প্রজাতন্ত্রের কর্মে নিযুক্ত প্রত্যেক ব্যক্তির কর্তব্য। সংবিধানের বিবৃত ধারাবলে বলা যায়, প্রজাতন্ত্রের কোথাও কর্মকর্তা-কর্মচারী শ্রেণি বিভাজিত হয়নি। অথচ রাষ্ট্রের সব কার্যক্রমে, সরকারি আদেশ-নির্দেশ, এমনকি সরকারি আবাসনসমূহের গেটেও কর্মকর্তাদের ও কর্মচারীদের পৃথক নামফলক ব্যবহার হচ্ছে। যা সাম্য ও ভ্রাতৃত্বের প্রজাতন্ত্র ও মহান মুক্তিযুদ্ধের আদর্শের পরিপন্থি। সংবিধান পরিপন্থি এ ধরনের স্যার সংস্কৃতি জনসাধারণ ও গণকর্মচারীদের মধ্যে মনস্তাত্ত্বিক বিভক্তি সৃষ্টি করেছে। কার্যত এ ধরনের শ্রেণিবিন্যাস ও সরকারি কর্মচারীদের থেকে দূরত্ব অনুভূতি সাধারণ নাগরিকদের গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ায় জনকল্যাণকর সমৃদ্ধ জাতিরাষ্ট্র গঠনে সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ থেকে বিরত রাখছে। এটি কৌলিন্য ও অভিজাতদের জন্য সংরক্ষিত একটি ডোমেন হিসেবে শাসকের ধারণার দিকে নিয়ে যাচ্ছে এবং জনগণের দ্বারা, জনগণের জন্য সরকারের সাংবিধানিক নির্দেশকে দুর্বল করে দিচ্ছে।

ইতিহাস পর্যালোচনা করলে ও পণ্ডিত ব্যক্তিদের প্রকাশনা থেকে লক্ষ্য করা যায়- স্যার সম্বোধনের বিষয়টি আমাদের সংস্কৃতির মধ্যে ছিল না। সেটি মধ্যযুগ বা মুঘল আমল যেটি হোক না কেন। ওই আমলে রাজা-বাদশাহদের জাঁহাপনা সম্বোধন করা হতো। পরবর্তীতে ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক ভারতে যখন ইংরেজ সংস্কৃতি চালু হতে থাকে, তখন ভারতীয় উপমহাদেশের প্রচলিত সম্বোধনের ভাষায় স্যার শব্দটি চলে আসে। যা পরবর্তীতে নব্য রাষ্ট্র পাকিস্তানেও বিদ্যমান ছিল। ‘স্যার’ (ঝরৎ) শব্দটি ইংরেজি হলেও এটির উৎপত্তি মধ্যযুগের ফরাসি দেশে ফ্রেঞ্চ শব্দ ‘স্যায়ার’ (ঝরৎব) থেকে, সেখানে জমিদার বা সামন্ত প্রভুদের প্রজারা সম্বোধন করত ‘স্যায়ার’ বলে। অৎব ডব ঝঃরষষ ঝষধাবং?- শিরোনামের এক নিবন্ধে ভারতীয় ফ্রিল্যান্স সাংবাদিক ও লেখক উদয়লাল পাই দাবি করেছেন, ফরাসি দেশে সামন্তযুগে স্যার শব্দ দ্বারা বুঝানো হতো- ঝষধাব ও জবসধরহ, আর ইংল্যান্ডে রাজকীয় নাইট উপাধিপ্রাপ্তদের নামের আগে ব্যবহৃত ঝওজ শব্দ দ্বারা নির্দেশ করে- ঝবৎাধহঃ ও জবসধরহ.

স্যার শব্দটি ইংরেজি ভাষায় ব্যবহৃত হওয়া শুরু করে ১২৯৭ খ্রিষ্টাব্দ থেকে, যখন ব্রিটিশ রাজতন্ত্রে বিশেষ ভূমিকা রাখার জন্য ‘নাইট’ উপাধিপ্রাপ্তদের নামের পূর্বে ‘স্যার’ যুক্ত করা শুরু হয়। ‘নাইট’ উপাধিপ্রাপ্ত ব্যক্তি তার নামের আগে ‘স্যার’ শব্দটি ব্যবহার করার অধিকার লাভ করেন। তবে এর জন্য তাকে ব্রিটিশ নাগরিক হতে হয়, নাইট উপাধিতে ভূষিত ব্যক্তি অন্য কোনো দেশের নাগরিক হলে নামের আগে ‘স্যার’ শব্দ ব্যবহার করতে পারেন না, তবে ইচ্ছা করলে নামের শেষে ‘কইঊ’ (কহরমযঃ ধহফ উধসব ঈড়সসধহফবৎ)– এই ইংরেজি তিনটি শব্দ সংযুক্ত করতে পারেন। বিল গেটস, অ্যাঞ্জেলিনা জোলি, স্টিভেন স্পিলবার্গসহ আরো অনেক নাইট উপাধিতে ভূষিত নন্দিত মানুষ ব্রিটিশ নাগরিক না হওয়ার কারণে নামের আগে ‘স্যার’ শব্দটি ব্যবহার করেন না।

কর্তৃত্ব, প্রভুত্ব ও আভিজাত্য বুঝাতে বঙ্গদেশে ‘ঝওজ’ শব্দের প্রচলন শুরু হয়, ভারতে ব্রিটিশ উপনিবেশ স্থাপনের সময় থেকে। ইংরেজরা আসার পর দেশি জনগণ কর্তৃক প্রশাসনিক কর্তাদের ‘স্যার’ হিসেবে সম্বোধনের রেওয়াজ চালু হয় মূলত শ্বেতাঙ্গ ব্রিটিশ শাসকদের প্রতি আনুগত্য প্রকাশ ও প্রভুত্ব স্বীকারের বহিঃপ্রকাশ হিসেবে। ইংরেজ কর্তাকে দেশি প্রজা ‘স্যার’ বলে সম্বোধন করলেও ইংরেজরা নিজেরা ঊর্ধ্বতন বাঙালিদের ‘বাবু’ বলে সম্বোধন করতে পছন্দ করতেন। বাঙালিরাও বাঙালিদের পরস্পরকে ‘বাবু’ই বলতেন।

বর্তমানে ‘স্যার’ শব্দের সবচেয়ে বহুল ব্যবহার দেখা যায় শিক্ষাঙ্গনে। সেখানে অবশ্য এখন এটি প্রভুত্ব বুঝানোর পরিবর্তে ব্যবহৃত হয় সম্মানার্থে। বাংলায় স্যারের পরিবর্তে আগে শিক্ষককে সম্বোধনে ‘মাস্টারমশাই’, ‘পণ্ডিতমশাই’ প্রভৃতি চালু ছিল। যার ব্যবহার এখন প্রায় অচল। ব্রিটিশ শিক্ষাব্যবস্থায় সম্বোধনের ক্ষেত্রে পুরুষ শিক্ষককে ‘স্যার’ এবং নারী শিক্ষককে ‘মিস’ (গরংং) ডাকা বহুল প্রচলিত, যেটি ঔপনিবেশিক শিক্ষাব্যবস্থায় এ দেশেও আত্মীকরণ হয়েছে। ফলে কোনো স্কুলের প্রধান পুরুষ হলে ‘হেড মাস্টার’ বা ‘হেড স্যার’ এবং নারী প্রধান হলে তাকে ‘হেড মিস্ট্রেস’ (ঐবধফ-সরংঃৎবংং) ডাকতে আমরা অভ্যস্ত হয়েছিলাম। কিন্তু সেখানেও আপত্তি রয়েছে। ইংরেজি গধংঃবৎ শব্দ এক অর্থে প্রভু বুঝায় এবং গরংঃৎবংং শব্দ পৃথিবীর অনেক স্থানে উপ-পতœী বা রক্ষিতাও বুঝিয়ে থাকে। আমেরিকা ও ইউরোপের বেশির ভাগ দেশে বর্তমানে শিক্ষককে ‘স্যার’ বা ‘মিস’ ডাকার পরিবর্তে ‘প্রফেসর’ কিংবা নাম ধরে ডাকার চল রয়েছে।

এ ধরনের স্যার সংস্কৃতি প্রজাতন্ত্রের গণকর্মচারীদের জনগণের প্রভু ভৃত্য মনোবৃত্তি প্রকাশের ধারণাকে উস্কে দিয়েছে। রক্তক্ষয়ী মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে প্রতিষ্ঠিত স্বাধীন বাংলাদেশের লক্ষ্য ছিল গণতান্ত্রিক ও সমতাভিত্তিক সমাজরাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা। বঙ্গবন্ধু চেয়েছিলেন ঔপনিবেশিক ভাবধারা ভেঙে প্রজাতন্ত্রের কর্মচারীরা জনসেবক হিসেবে গড়ে উঠবে। সার্বিক কর্মকাণ্ডে গণতান্ত্রিক শাসন, জবাবদিহিতা, স্বচ্ছতা ও জনস্বার্থ প্রাধান্যের প্রতি অঙ্গীকারের প্রতিফলন ঘটাবে। তিনি বিশ্বাস করতেন দেশের জনগণের প্রতি জনসেবকদের দায়িত্ব ও কর্তব্য রয়েছে। এ ধারণা থেকে তিনি সরকারি কর্মচারীদের কর্মচারী হিসেবে দেখে দেশের নাগরিকদের সেবা করার ক্ষেত্রে তাদের ভূমিকার ওপর জোর দেন। বঙ্গবন্ধু ঔপনিবেশিক ভাবধারা থেকে গণকর্মচারীদের বের করার লক্ষ্যে রাজনৈতিক সংশ্লিষ্ট বা ব্যক্তিগত সংযোগের পরিবর্তে যোগ্যতা, দক্ষতা ও কর্মদক্ষতার ভিত্তিতে নিয়োগ ও পদায়নের ওপর জোর দিয়েছিলেন। সরকারি কর্মচারীরা তাদের দায়িত্ব পালনে নৈতিক আচরণে উচ্চমান মেনে চলবেন, সেটাও তার প্রত্যাশা ছিল। যার মধ্যে স্বার্থের সংঘাত এড়ানো, দুনীতি থেকে বিরত থাকা ও জনসাধারণের সঙ্গে মিথস্ক্রিয়ায় ন্যায্যতা, নিরপেক্ষতা ও ন্যায়বিচারের নীতিগুলো অন্তর্ভুক্ত ছিল। তার প্রত্যাশা ছিল সরকারি কর্মচারীরা সরকারি পরিষেবা সরবরাহের সুবিধার্থে এবং নাগরিকদের অধিকার সুরক্ষিত ও তাদের চাহিদা পূরণ নিশ্চিত করবে।

স্বাধীন বাংলাদেশে গণকর্মচারীদের দায়িত্ববোধ ও প্রজাতন্ত্রের মানুষদের সঙ্গে তাদের ব্যবহার প্রসঙ্গ উল্লেখ করে বঙ্গবন্ধু গণকর্মচারীদের স্মরণ করিয়ে দিয়ে বলেছিলেন, ‘আপনি চাকরি করেন, আপনার মাইনে দেয় ঐ গরিব কৃষক। আপনার মাইনে দেয় ঐ গরিব শ্রমিক। আপনার সংসার চলে ঐ টাকায়। আমরা গাড়ি চড়ি ঐ টাকায়। ওদের সম্মান করে কথা বলুন, ইজ্জত করে কথা বলুন। ওরাই মালিক। ওদের দ্বারাই আপনার সংসার চলে।’ তিনি স্পষ্টই বলেছিলেন, এই স্বাধীনতা আমার কাছে প্রকৃত স্বাধীনতা হয়ে উঠবে, যেদিন বাংলার কৃষক-মজুর ও দুঃখী মানুষের সব দুঃখের অবসান হবে।

তবে বঙ্গবন্ধুর অনুপস্থিতিতে অগণতান্ত্রিক শক্তিগুলোর রাষ্ট্রীয় শাসনব্যবস্থা দখল ও তাদের ক্ষমতা দীর্ঘায়িত করতে গিয়ে মুক্তিযুদ্ধের চেতনাবিরোধী আমলাতন্ত্রের দুর্বৃত্তায়ন, রাজনীতি দুর্নীতি আক্রান্ত হওয়া, রাজনীতিতে ব্যবসায়ীদের আধিপত্য বিস্তার, মানবিক মূল্যবোধ অর্থবিত্তের কাছে সমর্পিত হওয়া, শিক্ষা বাণিজ্যকরণ ইত্যাদির ব্যাপক প্রভাব সমাজরাষ্ট্রে যে কালোছায়া ফেলেছে, সেখানে রাষ্ট্রের গণতান্ত্রিক মূল্যবোধ ক্রমেই দুর্বল থেকে দুর্বল হয়েছে। রাষ্ট্রের মালিক সাধারণ জনগণ ক্রমেই ক্ষমতাহীন হয়েছে এবং শক্তিশালী হয়েছে ক্ষমতাপৃষ্ঠ শক্তিগুলো। দুর্ভাগ্যজনকভাবে লক্ষ্য করা গেছে, আইনপ্রণেতাদের ক্ষমতাবিস্তারের মানসিক তাড়নার কারণে দেশে স্থানীয় সরকারব্যবস্থা শক্তিশালী হতে পারেনি। বরং যুগোপযোগী আইনপ্রণয়নে মুখ্য ভূমিকা রাখার চেয়ে সংসদ সদস্যরা নির্বাচনী এলাকা এবং ব্যবসা-বাণিজ্যে প্রভাব বিস্তারে বেশি মনোযোগী হয়েছে। অন্যদিকে সত্যিকার রাজনৈতিক সংগঠন শক্তিশালী না হওয়ায় কেন্দ্র থেকে তৃণমূল পর্যায়ে আমলাতন্ত্র, পুলিশ প্রশাসন ও অন্যান্য প্রশাসনিক কর্তাব্যক্তিরা শক্তিশালী হয়ে উঠেন। ফলে তারা যে জনগণের ট্যাক্সের টাকায় রাজকর্মচারী হিসেবে নিয়োজিত, সেই দায়বোধ ভুলে গিয়ে জনগণের প্রভু হিসেবে নিজেদের প্রতিষ্ঠিত করেছেন। তাই দেশের মালিক সেবাগ্রহণকারী জনগণকে যেখানে প্রজাতন্ত্রের সব কর্মচারীকেই এই স্যার সম্বোধন বাঞ্ছনীয় ছিল, সেখানে জনগণই গণকর্মচারীকে স্যার বলে সম্বোধন করতে হয়। এর ব্যত্যয়ে অনেক অনভিপ্রেত ঘটনার সূত্রপাত হয়েছে। যা স্বাধীনতা ও মুক্তিযুদ্ধের চেতনার আদর্শিক দর্শনের সঙ্গে সাংঘর্ষিক।

স্যার সম্বোধনের এ ধরনের ঔপনিবেশিক সংস্কৃতি জনগণের ক্ষমতায়নকে স্বীকৃতি দেয় না। বরং নানা ধরনের সামাজিক ও রাষ্ট্রিক বৈষম্যকে উস্কে দেয়। লিঙ্গভেদে স্যার সম্বোধনের প্রতিরূপ ম্যাডাম সর্বদা একই কর্তৃত্বের অন্তর্নিহিতা বহন করে না। এই বৈষম্য পেশাদার ও একাডেমিক পরিবেশে লিঙ্গসমতা অর্জনে চলমান চ্যালেঞ্জগুলোকে তুলে ধরে। লিঙ্গ নিরপেক্ষ বিকল্পগুলো নিয়ে বিতর্কসহ শিরোনাম ও সম্মানকে কেন্দ্র করে বিকশিত ভাষা, অন্তর্ভুক্তি, সম্মান এবং কীভাবে সামাজিক নিয়মগুলো ভাষা দ্বারা আকৃতি ও গঠন করে, সে সম্পর্কে বিস্তৃত কথোপকথনের দিক নির্দেশ করে। স্যারের স্থায়ী ব্যবহার ঔপনিবেশিক উত্তরাধিকার, সামাজিক শ্রেণিবিন্যাস এবং সাংস্কৃতিক অনুশীলনের জটিল নেভিগেশনকে অন্তর্ভুক্ত করে। সামাজিক গতিশীলতা, অন্তর্ভুক্তি ও পরিবর্তনশীল সামাজিক নিয়মগুলোর জন্য এর প্রভাবগুলোর চারপাশে বিকশিত বক্তৃতা একটি অঞ্চলকে প্রবাহিত করে। ভবিষ্যতের দিকে তাকানোর সময় তার অতীতের সঙ্গে লড়াই করে।

যেহেতু দক্ষিণ এশিয়া তার পরিচয় ও সামাজিক কাঠামোকে পুনঃসজ্ঞায়িত করে চলেছে, এই ধরনের পদগুলোর চারপাশে কথোপকথনগুলো একটি আকর্ষণীয় লেন্স হিসেবে থাকবে, যার মাধ্যমে এর সামাজিক সাংস্কৃতিক বিবর্তন দেখা যায়। সংস্কৃতি, ইতিহাস ও একটি সংবিধান, যা গণতন্ত্র, প্রজাতন্ত্রের নীতি ও আইনের শাসনকে ধারণ করে বাংলাদেশ একটি সার্বভৌম রাষ্ট্র হিসেবে দাঁড়িয়ে আছে। প্রজাতন্ত্রের কর্মচারীদের সম্বোধন করার জন্য কর্তৃত্ববাদী স্যার ব্যবহার উত্তরাধিকার, সাংস্কৃতিক চর্চা একটি সূ² আন্তঃযোগাযোগ উপস্থাপন করে। এই অভ্যাসটি সামাজিক গতিশীলতায় প্রভাব ফেলে, সম্ভাব্য ক্ষমতার ভারসাম্যহীনতাকে স্থায়ী করে এবং সমতাবাদী মিথস্ক্রিয়াকে বাধা দেয়। যা সামাজিক ন্যায়বিচার ও আইনের শাসন প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে অন্যতম বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে। (চলবে)

লেখক: ড. মহসীন হাবিব : উন্নয়ন গবেষক, আন্তর্জাতিক নীতি উপদেষ্টা ও সহযোগী অধ্যাপক, লরেন্টিয়ান ইউনিভার্সিটি, সাডবেরি, অন, কানাডা।

কৃষি গুচ্ছের ভর্তি পরীক্ষা স্থগিত - dainik shiksha কৃষি গুচ্ছের ভর্তি পরীক্ষা স্থগিত র‌্যাঙ্কিংয়ে এগিয়ে থাকা কলেজগুলোর নাম এক নজরে - dainik shiksha র‌্যাঙ্কিংয়ে এগিয়ে থাকা কলেজগুলোর নাম এক নজরে দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে - dainik shiksha দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে কওমি মাদরাসা: একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে - dainik shiksha কওমি মাদরাসা: একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে please click here to view dainikshiksha website Execution time: 0.0070600509643555