বাংলা ভাষার অনন্য এক ব্যক্তিত্ব এবং সংস্কৃতজ্ঞ পণ্ডিত ছিলেন শিক্ষাবিদ হরিচরণ বন্দ্যোপাধ্যায়। তিনি শান্তিনিকেতনের অধ্যাপক এবং ‘বঙ্গীয় শব্দকোষ’ অভিধান প্রণেতা ছিলেন।
শিক্ষাবিদ হরিচরণ বন্দ্যোপাধ্যায় ১৮৬৭ খ্রিষ্টাব্দের এই দিনে বৃটিশ ভারতের বর্তমানে পশ্চিমবঙ্গের উত্তর চব্বিশ পরগনা জেলার রামনারায়ণপুরে জন্মগ্রহণ করেন। তার বাবার নাম নিবারণচন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায়। মায়ের নাম জগৎতারিণী দেবী। পৈতৃক বাড়ি যশাইকাটি গ্রামে। এই গ্রামেই তার বিদ্যারম্ভ। এখানকার বিভিন্ন স্কুলের পাঠ শেষে ভর্তি হন কলকাতার মেট্রোপলিটন কলেজে বর্তমানে বিদ্যাসাগর কলেজে। কিন্তু বিএ তৃতীয় বর্ষে স্টুডেন্ট ফান্ডের টাকা বন্ধ হওয়ায় আর পড়াশোনা করতে পারেননি। আর ওই সময়েই তার বাবা মারা যান।
বাবা মারা যাবার পর কিছুকাল গ্রামের স্কুলে শিক্ষকতা করেন। পরে কলকাতায় মেদিনীপুরের নাড়াজোলের কুমার দেবেন্দ্রলাল খানের গৃহশিক্ষকতা করেন। ১৯০১ খ্রিষ্টাব্দে কলকাতা টাউন স্কুল প্রতিষ্ঠিত হলে সেখানে প্রধান পণ্ডিত রূপে যোগদান করেন। কিন্তু সেখানে মাসিক বেতন কম হওয়ায় বাধ্য হয়ে বছর খানেক পর শিক্ষকতা ছেড়ে দেন।
পরে তার এক অগ্রজের চেষ্টায় সুপারিনটেন্ডন্টের কাজ পান রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের বর্তমানে বাংলাদেশে অবস্থিত পতিসর কাছারিতে। ইতিমধ্যে কোনো একসময় রবীন্দ্রনাথ জমিদারি পরিদর্শনে এসে তার সংস্কৃত জ্ঞানের পরিচয় পান এবং ১৯০২ খ্রিষ্টাব্দে তাকে শান্তিনিকেতনে নিয়ে আসেন। সেসময় থেকেই তিনি ব্রহ্মচর্যাশ্রমে সংস্কৃতের অধ্যাপক হিসেবে অতিবাহিত করে ১৯৩২ খ্রিষ্টাব্দে অবসর নেন।
অধ্যাপনাকালে রবীন্দ্রনাধের ইচ্ছায় ১৯০৫ খ্রিষ্টাব্দে ‘বঙ্গীয় শব্দকোষ’ সংকলনের কাজ শুরু করেন। তার সম্পূর্ণ একক প্রচেষ্টায় চল্লিশ বছর পর ১৯৪৫ খ্রিষ্টাব্দে এই দুরূহ কাজ সম্পন্ন করলেন। বিশ্বভারতী পাঁচটি খণ্ডে প্রকাশ করে তার সংকলিত ‘বঙ্গীয় শব্দকোষ’। তবে বিশ্বভারতী থেকে প্রকাশের পূর্বে তিনি নিজের অর্থ ব্যয়ে ১৩৪০ বঙ্গাব্দ বা ১৯৩৩ খ্রিষ্টাব্দ থেকে ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র অংশে এই অভিধানের ধারাবাহিক প্রকাশ আরম্ভ করেন কলকাতার ‘বিশ্বকোষ’ প্রেস হতে। ১৩৫৩ বঙ্গাব্দে ১০৫ খণ্ডে এই মুদ্রণ সমাপ্ত হয়। এর কিছুদিন পর ১০৫ খণ্ডের এই অভিধান পাঁচ ভাগে ক্রমে ক্রমে প্রচারিত হয়। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর এই শব্দকোষকে বাংলাভাষার এক সম্পদ বলে আখ্যা দেন।
১৯৬৬-৬৭ খ্রিষ্টাব্দে সাহিত্য একাডেমিও তার বঙ্গীয় শব্দকোষ দুটি খণ্ডে প্রকাশ করে। হরিচরণ বন্দ্যোপাধ্যায় রচিত উল্লেখযোগ্য গ্রন্থগুলো হলো-সংস্কৃত প্রবেশ, পালিত প্রবেশ, ব্যাকরণ কৌমুদী, কবির কথা এবং রবীন্দ্রনাথের কথা।
এ ছাড়া, তিনি ম্যাথু আর্নল্ডের'শোরাব রোস্তম' এবং বশিষ্ট বিশ্বামিত্র','কবিকথা মঞ্জুষা' প্রভৃতি গ্রন্থ অমিত্রাক্ষর ছন্দে অনুবাদ করেছিলেন ।
বাংলা ভাষায় অসামান্য কাজের স্বরূপ স্বীকৃতিও তিনি পেয়েছেন। ১৯৪৪ খ্রিষ্টাব্দে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে সরোজিনী বসু স্বর্ণপদক এবং ১৯৫৪ খ্রিষ্টাব্দে শিশির কুমার স্মৃতি পুরস্কার পেয়েছিলেন। ১৯৫৭ খ্রিষ্টাব্দে বিশ্বভারতী বিশ্ববিদ্যালয় ডিলিট এবং সর্বোচ্চ স্বীকৃতি দেশিকোত্তম উপাধি দ্বারা সম্মানিত করে। ১৯৫৯ খ্রিষ্টাব্দের ১৩ জানুয়ারি সংস্কৃতজ্ঞ পণ্ডিত হরিচরণ বন্দ্যোপাধ্যায় পরলোকগমন করেন।