হারুনের নির্যাতনের লোমহর্ষক ঘটনার বর্ণনা দিলেন সমন্বয়ক বাকের - দৈনিকশিক্ষা

হারুনের নির্যাতনের লোমহর্ষক ঘটনার বর্ণনা দিলেন সমন্বয়ক বাকের

দৈনিক শিক্ষাডটকম প্রতিবেদক |

কোটা সংস্কার আন্দোলন থেকে শেখ হাসিনা সরকার পতন আন্দোলনে নেতৃত্ব দেয় বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন। প্ল্যাটফর্মটির অন্যতম সমন্বয়ক আবু বাকের মজুমদার। সোমবার (২৩ সেপ্টেম্বর) সকালে আওয়ামী শাসন আমলে ডিবিপ্রধান হারুন অর রশীদের নির্মম নির্যাতনের কথা ফেসবুক স্ট্যাটাসে তুলে ধরেছেন তিনি। 

হারুনের সঙ্গে বাগবিতণ্ডায় জড়ানোর পর-

হারুনের যেই ভাতের হোটেল চেনেন, সেই হোটেলে হারুন খাচ্ছিলো। ডিবি হেফাজতের দ্বিতীয় দিন আমাকে, নাহিদ ভাইকে, আসিফ ভাইকে তার সামনে নিয়ে যাওয়া হয়। হারুনের ব্যবহার ছিল অত্যন্ত বাজে এবং হল ছাত্রলীগের উপসম্পাদক ক্যাটাগরির। আমাদেরকে বলতেছিল, আমি নেতা ছোট করি, নেতা বানাই না! দেখোস নাই, নুরুরে কি করে ছেড়ে দিছি! নুর এখন রিমান্ডে কান্নাকাটি করে।

সে যেভাবেই কথা বলুক না কেনো আমরা তিনজন খুব দৃঢ়ভাবে কথা বলে যাচ্ছিলাম। এক পর্যায়ে সে আমাকে বলে, তুই শিবির! আমি বলি, না আমি শিবির না! সে আবারও (একটু উচ্চ শব্দে) বলে, তুই শিবির। আমি আবারও না বলি (ওর থেকে উচ্চ শব্দে)। সে আসিফ ভাই, নাহিদ ভাইকে দেখিয়ে দিয়ে বলে, দেখ, সে কীভাবে কথা বলে! ওর কথা বলার মাঝেই ওর থেকে উচ্চ শব্দে বলতে থাকি, আমার পুরো বাড়ির মানুষ মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করে, আমার বাড়িতে যোদ্ধারা ক্যাম্প করেছিল, আমি সেই বৃহত্তর পরিবারের সন্তান। আমি তার থেকে উচ্চবাচ্য করায় সে প্লেট ছুড়ে ফেলে দিয়ে এক অফিসারকে ইশারা দিয়ে বলে আমাদেরকে নিয়ে যেতে।

আমাদের তিনজনকে তিনটি আলাদা রুমে নিয়ে যাওয়া হয়। রুমে যাওয়ার ৩-৪ মিনিট পর দুইজন লোক এসে দরজায় আসতে বলে, তাদের হাতে ছিল জম টুপি (কালো বড় টুপি, গলা পর্যন্ত ঢেকে যায়) এবং হাতকড়া। বুঝে গেছিলাম, হারুনের সঙ্গে পার্সোনালিটি দেখানোর জন্য খারাপ কিছু হতে যাচ্ছে। দরজায় আসার সঙ্গে সঙ্গে টুপিটি পরায়, তারপর হাতকড়া পরায়। নিশ্বাস নিতে কষ্ট হচ্ছিল, দুনিয়ার আলো কিছুই দেখা যায় না, ভয়ংকর একটা পরিবেশ। ডানবামে ঘুরিয়ে হাঁটানো শুরু করল, বারবার মনে হচ্ছিল ছাদের পাশে নিয়ে এই অবস্থায় ফেলে দেয় কি না! আর জিজ্ঞেস করতেছিলাম, নাহিদ ভাই, আসিফ ভাইকেও নিচ্ছে কি না?, তারা জানালেন, তারা এ বিষয়ে জানে না, উনাদের দায়িত্ব শুধু আমাকে নিয়ে যাওয়া। নাহিদ ভাই, আসিফ ভাই অনেক অসুস্থ ছিলেন, উনাদের জন্য ভয় হচ্ছিল। যাই হোক, তারপর লিফটে, আবার হেঁটে, আবার সিড়িতে, এভাবে কোনো একটা রুমে নিয়ে গেল। একটা জিনিস বারবার মাথায় আসছিল যে আমাকে মেরে ফেলে কি না, ফ্যাসিস্ট সরকারের কাছে তো বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড সাধারণ ঘটনা ছিল। তারপর রুমে নিয়ে দেয়ালের দিকে ঘুরিয়ে জম টুপি খুলে গামছা দিয়ে খুব শক্ত করে চোক বাঁধল আর হাতগুলো বড় গামছা দিয়ে বাঁধল। হাত বাঁধার সময় এমনভাবে বাঁধলো যেনো হাতের বেশি জায়গাজুড়ে গামছা থাকে। তারপর উল্টো ঘুরতে বলে, একপায়ে দাঁড়াতে বলে। টানা ৭২ ঘণ্টা না ঘুমানোর জন্য শরীরে ব্যালেন্স ছিল না।দাঁড়ানোর চেষ্টা করেও বারবার ব্যার্থ হই।

শেষে সোজা হয়েই দাঁড়াতে বলে এবং জিজ্ঞাবাদ শুরু করে। ওদের কথায় বুঝতে পারছিলাম যে, ওরা মোটামুটি আমাদের সবকিছু জানে। আমাকে শুরুতেই বলে, তুই তো জুনের ৯ তারিখ থেকে ৩০ তারিখ পর্যন্ত সারাদেশকে সংগঠিত করতে লিড দিছোস, তোর তো আন্দোলনকে বড় করার অনেক খায়েশ! তোরে এগুলো কে শিখাইছে? তোর তো বয়স বেশি না! ট্রেনিং পাইছোস কই? উত্তরে আমি বলি, আমি ছাত্রসংগঠন করি, গণতান্ত্রিক ছাত্রশক্তির ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সদস্য সচিব, সংগঠন শুরুতে দাঁড় করানোর জন্য এবং পরবর্তীতে বিস্তারের জন্য দীর্ঘদিন ধরে আমি মানুষকে সংগঠিত করার জন্য কাজ করে যাচ্ছিলাম, সেই অভিজ্ঞতা কাজে লাগিয়েছি। তারপর কিছুক্ষণ প্যাঁচায়! তারপর আবার, তুই ফ্রন্টলাইনে আসিস না কেন? তুই কি মনে করিস তোরে আমরা চিনি না? তুই কোথায় কি করিস সব তথ্য আছে। আমি চুপ থাকি, পরে আবার বলে কথা বলিস না কেন? আমি বলি, ব্যাকস্টেজে কাজ করতে পছন্দ করি। আবার বলে, ১৫ তারিখ একাত্তর হলে যখন মারামারি হয় তখন তুই কই ছিলি? আমি বলি, একাত্তর হলের সামনেই। সে বলে, তুই তো প্রথম মারামারি লাগাইছস, মারামারিতে নেতৃত্ব দিছস! আমি বলি, ছাত্রলীগ আমাদের মারে, পরে আমরা প্রতিরোধ করি। এভাবে অনেক প্রশ্ন উত্তর হয় ১৫ জুলাই নিয়ে। 

তারপর জিজ্ঞেস করে, তোর গুরু কে? উত্তর দেই আমার কোনো গুরু নাই। শুধুমাত্র জাতীয় স্বার্থে সংগঠন করি, আর আন্দোলনও ঠিক একই কারণে করে যাচ্ছি। এই বিষয়েও আরও অনেক সাবস্টিটিউট প্রশ্ন উত্তর হয়।

তারপর আবার, তুই কি সরকারি চাকরি করবি? আমি বলি করতেও পারি, তবে আমার রাজনীতি ও একাডেমি নিয়ে আগ্রহ আছে। এটা নিয়ে অনেক প্যাঁচানোর চেষ্টা করে। এ রকম আরও অসংখ্য প্রশ্ন জিজ্ঞেস করে (বেঁচে থাকলে সব লিখবো), সর্বশেষ বলে, সরকার তো কোটা নিয়ে সব দাবিদাওয়া মেনে নিয়েছে তারপরও এখন কিসের আন্দোলন? আমি চুপ থাকি, ওরা চিল্লাপাল্লা করে, ঝাড়াঝাড়ি করে, তখনো চুপ থাকি। একজন বলে উঠে, ওরে ঝুলা। আমি তখনো চুপ থাকি। তারপর পাশের রুমে নিয়ে যাওয়া হয়, নিয়ে হাত ওপরে ঝুলিয়ে বাঁধা হয়। আমি বলি পিঠে মারলে মরে যাবো, বাম পায়ে একটু সমস্যা আছে, বাম পা’টা ভেঙে যাবে। ওরা কিছু বলে না। একপর্যায়ে নিতম্বে মোটা শক্ত কোনো লাঠি দিয়ে একের পর এক আঘাত করে, আর আমি চিল্লানো দিয়ে উঠি, আর ওরা বলে, প্রাইমিনিস্টারকে ধন্যবাদ দিয়ে বিবৃতি দিবি? আমি বলি, না। এরকমভাবেই চলতে থাকে। স্কুল লাইফে টিচারদের অনেক মাইর খেয়েছিলাম, স্যাররা বেত ব্যবহার করতেন, মারার সময় নার্ভ সিস্টেম অটোমেটিক একটা প্রটেক্টিভ ভূমিকায় চলে যেতো, অন্তত ম্যান্টাল প্রিপারেশন থাকতো। কিন্তু এখানে তা নাই, চোখ বন্ধ, হাত বাঁধা, যেন হুট করে লাঠির আঘাত লাগছে। খুব ভয়ংকর লাগছিল এবং ব্যথা তুলনামূলক বেশি পাচ্ছিলাম। আমি পানি চাই, বোতলের ছিপি করে এক ছিপি (মুখ) পরিমাণ পানি দিয়েছিলো। গলা শুকিয়ে যেনো কাঠ হয়ে গিয়েছিল। বেধড়ক মারার পর এক পর্যায়ে সামনে থেকে কেউ একজন বলে, ওরে রেস্ট দে। বড় নিশ্বাস নিলাম। আর ভাবতেছিলাম, যতো ভয় পাইছি যে সহ্য করতে পারবো কি না, ততো না! আসলে বেঁধে পেটালে কার না সহ্য হয়! যাইহোক তারপর দ্বিতীয় দফায় মার খাওয়ার জন্য মানসিক প্রস্তুতি নিচ্ছিলাম।

ওপরে হাত ঝুলানো হলেও পায়ের আঙুল ফ্লোরে লাগিয়ে একটুখানি ভর দেওয়া যাচ্ছিলো। প্রথম দফা মারার পর আমাকে প্রায় এক ঘণ্টা বা তারও বেশি এভাবে ঝুলিয়ে রেখেছিলো।আর আমি পানি চাইলে বোতলের মুখে (চিপিতে) এক মুখ পানি দিতো। এভাবেই যাচ্ছিলো, আর মনে মনে সেকেন্ড রাউন্ডের জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছিলাম। আর ভাবতেছিলাম, নাহিদ ভাই আর আসিফ ভাইয়ের যেনো কি অবস্থা! ওই সময়ে আমি তুলনামূলক উনাদের থেকে স্ট্রং ছিলাম। যাই হোক, এক পর্যায়ে আমার অনেক প্রস্রাবের বেগ হলে তাদেরকে জানালে ওয়াশরুমে নিয়ে যায়। ওয়াশরুম থেকে বের হওয়ার পর আমাকে আর ঝোলায়নি, এবার একটা চেয়ারে বসতে দেয়। হাত-চোখ বাঁধা অবস্থায় পড়ে থাকি আর সেকেন্ড রাউন্ডের অপেক্ষা করি। সেকেন্ড রাউন্ড কখন শুরু হবে, জিগ্যেস করলে সামনে থাকা ব্যক্তি বলেন, তিনি জানেন না তার স্যার উপস্থিত নাই। নরমালি ঝুলানো অবস্থা থেকে বসালে ব্যথা আরও বেড়ে যায়, ঝুলানো থেকে খোলার পর হাঁটতে অনেক কষ্ট হচ্ছিলো। এভাবে চলতে চলতে এক পর্যায়ে আবার দুজন এসে হাত খুলে দেয় কিন্তু চোখ বাঁধা অবস্থায় থাকে। হাঁটতে গিয়ে দেখি হাঁটা যাচ্ছে না, একপর্যায়ে ওদের দুই কাঁধের ওপর আমার দুহাতের ভর দিয়ে অনেক কষ্টে আমাকে যে রুমে রাখা হতো সেই রুমে নিয়ে যাওয়া হয়। আমার রুমে, যারা ছিলেন, তাদের একজন বলতেছিল, সুস্থ একটা মানুষকে নিয়ে দেখ কি করে দিছে, এদেরকে আল্লাহ মাফ করবে না!

শিক্ষা ব্যবস্থাপনায় ধর্মীয় শিক্ষা বাধ্যতামূলক করার দাবি - dainik shiksha শিক্ষা ব্যবস্থাপনায় ধর্মীয় শিক্ষা বাধ্যতামূলক করার দাবি কারিগরি শিক্ষকদের অক্টোবর মাসের এমপিওর চেক ছাড় - dainik shiksha কারিগরি শিক্ষকদের অক্টোবর মাসের এমপিওর চেক ছাড় সরকারি কর্মচারীদের ৯ দফা নির্দেশনা - dainik shiksha সরকারি কর্মচারীদের ৯ দফা নির্দেশনা স্কুল-কলেজে বেতন ছাড়া সব ফি বেঁধে দিলো সরকার - dainik shiksha স্কুল-কলেজে বেতন ছাড়া সব ফি বেঁধে দিলো সরকার সব শিক্ষকের স্বার্থ সংরক্ষণ করে বদলির নীতিমালা : সাক্ষাৎকারে শিক্ষা উপদেষ্টা - dainik shiksha সব শিক্ষকের স্বার্থ সংরক্ষণ করে বদলির নীতিমালা : সাক্ষাৎকারে শিক্ষা উপদেষ্টা ঢাবিতে মুক্তিযোদ্ধা কোটা রেখেই ভর্তি কার্যক্রম - dainik shiksha ঢাবিতে মুক্তিযোদ্ধা কোটা রেখেই ভর্তি কার্যক্রম ক্যামব্রিয়ানের বাশারকে গ্রেফতারের দাবিতে আন্দোলন অব্যাহত - dainik shiksha ক্যামব্রিয়ানের বাশারকে গ্রেফতারের দাবিতে আন্দোলন অব্যাহত শিক্ষক নিবন্ধন ভাইভা: অষ্টম দিনে যেসব প্রশ্নের মুখোমুখি - dainik shiksha শিক্ষক নিবন্ধন ভাইভা: অষ্টম দিনে যেসব প্রশ্নের মুখোমুখি কওমি মাদরাসা: একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে - dainik shiksha কওমি মাদরাসা: একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে ছাত্ররাজনীতি বন্ধ করা কল্যাণের হবে না: ছাত্রদল সম্পাদক - dainik shiksha ছাত্ররাজনীতি বন্ধ করা কল্যাণের হবে না: ছাত্রদল সম্পাদক দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে - dainik shiksha দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে কওমি মাদরাসা একটি অসমাপ্ত প্রকাশনার কপিরাইট সত্ত্ব পেলেন লেখক - dainik shiksha কওমি মাদরাসা একটি অসমাপ্ত প্রকাশনার কপিরাইট সত্ত্ব পেলেন লেখক please click here to view dainikshiksha website Execution time: 0.0035488605499268