এ যেন ‘সরিষার মধ্যে ভূত’ প্রবাদের মতোই ঘটনা। ‘যে সরিষা দিয়ে ভূত তাড়াব সেই সরিষার মধ্যেই ভূত’। দেশের যে আইন-শৃঙ্খলা বাহিনী দিয়ে মাদকমুক্ত, অপরাধ দমন করার কথা সেই আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা মাদকাসক্ত হচ্ছেন, অপরাধে জড়িয়ে পড়ছেন! আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা দেশের শান্তি শৃঙ্খলা রক্ষার অজুহাতে মাঠের বিরোধী দলগুলোর নেতাকর্মীদের ঠেঙ্গানোর সাফল্য (!) দেখাচ্ছেন ক্ষমতাসীন দলের তল্পিবাহকে পরিণত হচ্ছেন। কিন্তু অপরাধ দমন এবং মাদকমুক্ত দেশ গড়তে ততটা সফলতা দেখাতে পারছেন না? বরং মাদকবিরোধী অভিযানে গিয়ে পুলিশ বাহিনীর কিছু কিছু সদস্য মাদকাসক্ত হচ্ছেন! পুলিশ বাহিনীর নিজেদের প্রয়োজনেই এই কার্যক্রম জোরদার করা উচিত বলে মনে করছেন সমাজ বিজ্ঞানী ও অপরাধ বিজ্ঞানীরা।
পুলিশ বাহিনীর কেন্দ্র থেকে যখন মাদক ‘জিরো টলারেন্স’ ঘোষণা করা হয়েছে; তখন মাদকাসক্ত হয়ে পুলিশ সদস্যরা চাঁদাবাজি, ঘুষ, দুর্নীতি ও মাদক কারবারসহ নানা ধরনের অপরাধে জড়িয়ে পড়ছেন। এ জন্য ডোপটেস্টের মাধ্যমে চলছে পুলিশের মধ্যে শুদ্ধি অভিযান। গত বছরের অক্টোবর মাস পর্যন্তÍ সারাদেশে তিন শতাধিক পুলিশ সদস্যকে মাদকাসক্ত হিসেবে শনাক্ত করা হয়েছে। চাকরিচ্যুত হয়েছে প্রায় ২০০ জন। এ ছাড়া ব্যবস্থা নেয়ার আগে একজন মারা গেছেন এবং আরেকজন অবসরে চলে গেছেন। ডিএমপির কনস্টেবল থেকে এসআই পদমর্যাদার ১২৬ জন মাদকাসক্ত হিসেবে শনাক্ত হয়েছে। চাকরিচ্যুত হয়েছে ১১৬ জন। এছাড়া রাজধানী ঢাকা ছাড়াও বরিশাল, রাজশাহীসহ বিভিন্ন রেঞ্জ ও মেট্রোপলিটনে ডোপটেস্ট অনেক পুলিশ সদস্যের পজিটিভ হয়েছে। রাজধানীর বাইরেও যাদের পজিটিভ হয়েছে তাদের বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করা হচ্ছে। পুলিশের বিরুদ্ধে নানা ধরনের অভিযোগের ব্যাপারে কঠোর অবস্থান নিয়েছেন শীর্ষ কর্মকর্তারা। তবে সম্প্রতিক সময়ে পুলিশের মধ্যে ডোপটেস্ট জোর দেয়া হওয়ায় বাহিনীর কতিপয় সদস্য ও কর্মকর্তার মধ্যে আতঙ্ক দেখা দিয়েছে।
পুলিশ সদর দফতর সূত্রে জানা গেছে, ডোপটেস্টে যাদের চূড়ান্তভাবে পজিটিভ হবে তাদেরকে গ্রেফতার, মামলা দায়ের ও প্রত্যাহারসহ শাস্তিমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করা হচ্ছে। ডোপ টেস্টের মাধ্যমে সারাদেশের পুলিশ বাহিনীর সদস্যের মধ্যে সতর্ক বার্তা পৌঁছে দেয়া হচ্ছে। এখন পুলিশ বিভাগে যারা নতুন চাকরিতে আসবেন তাদের ডোপটেস্ট প্রক্রিয়া পর্ব অতিক্রম করেই চাকরিতে যোগ দিতে হবে।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে পুলিশ সদর দফতরের একজন দায়িত্বশীল কর্মকর্তা গতকাল শনিবার বলেন, পুলিশ সদর দপ্তরে সারা দেশের তথ্য সংরক্ষিত নেই। সংশ্লিষ্ট ইউনিট ডোপটেস্টে মাদকাসক্ত হিসেবে শনাক্ত পুলিশ সদস্যদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিলেও পুলিশ সদর দফতরকে তা জানায় না। তবে ২০২২ সালের অক্টোবর মাস পর্যন্ত এক পরিসংখ্যানে জানা যায় সারাদেশে দুই শতাধিক পুলিশ সদস্যকে বিভিন্ন সময় মাদকাসক্ত থাকার কারণে চাকরি থেকে বরখাস্ত করা হয়েছে। এর হালনাগাদ কোনো তথ্য নেই বলে ওই কর্মকর্তা মন্তব্য করেন।
ডোপটেস্টের রিপোর্ট থেকে জানা যায়, মাদকাসক্ত পুলিশ সদস্যরা ফেনসিডিল, ইয়াবাসহ অন্যান্য মাদক নিয়মিত গ্রহণ করত। ডোপ টেস্টে মাদকাসক্ত হিসেবে শনাক্ত হওয়া তিন শতাধিক সদস্যের মধ্যে ৯৮ জনই কনস্টেবল। বাকিদের মধ্যে পুলিশ পরিদর্শক, এসআই, ট্রাফিক সার্জেন্ট, এএসআই এবং নায়েক রয়েছেন।
অপরাধ বিশেষজ্ঞরা বলেছেন, পুলিশ বিভাগে অভ্যন্তরীণ মনিটরিং ব্যবস্থা আরও শক্তিশালী করা অপরিহার্য। পুলিশ বাহিনীর সদস্যের বিরুদ্ধে যে ডোপটেস্টের মাধ্যমে মাদকাসক্ত পুলিশ সদস্যের বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ ও বের করে দেয়া হচ্ছে তাতে দারুণ ফল দেবে। তবে এ ক্ষেত্রে ঊর্ধ্বতন পুলিশ কর্মকর্তাদেরও ডোপটেস্টের আওতায় আনা প্রয়োজন বলে বিশেষজ্ঞরা মনে করেন।
আইজিপি চৌধুরী আবদুৃল্লাহ আল-মামুন গতকাল জানান, পুলিশ বাহিনীর চাকরির শুরু থেকেই ডোপটেস্ট করা হচ্ছে। এছাড়া বিভিন্ন্ পর্যায়েও ডোপটেস্ট করা হচ্ছে। মাদকের সঙ্গে কোনো পুলিশ সদস্য বা কর্মকর্তার সম্পৃক্ততা প্রমাণ হলে তাকে ছাড় দেয়া হবে না, এ ব্যাপারে জিরো-টলারেন্স নীতি নেয়া হয়েছে। পুলিশের সব পর্যায়ে এমন বার্তা পাঠানো হয়েছে যে, বাহিনীর কোন সদস্য মাদক গ্রহণ করবে না, মাদকের ব্যবসার সাথে কোনোভাবে সম্পৃক্ত হবে না এবং যারা মাদকের ব্যবসা করেন তাদের সাথে কোনোভাবে সংশ্লিষ্ট রাখবেন না বা সহযোগিতা করবেন না। মাদকাসক্ত কোন পুলিশ সদস্যের বাহিনীতে স্থান নেই বলে চৌধুরী আবদুৃল্লাহ আল-মামুন মন্তব্য করেন।
পুলিশ সদর দফতর সূত্রে জানা গেছে, সারাদেশের পুলিশ বাহিনীর সদস্যের মধ্যে এ পর্যন্ত ডোপটেস্টে পজিটিভ হয়েছে তিন শতাধিক। যাদের চূড়ান্তভাবে পজিটিভ হয়েছে তাদের মধ্যে অন্তত ২০০ জন সাময়িকভাবে বরখাস্ত হয়েছে। চূড়ান্ত বরখাস্তের জন্য আরও ১০ জনের বিরুদ্ধে চাকরিচ্যুত করার বিষয়টি প্রক্রিয়াধীন। বিভাগীয় শাস্তি ও সতর্ক করে দেয়া হয়েছে অন্তত ৬০ জনকে। এর মধ্যে ঢাকা মহানগরী পুলিশে অভিযুক্ত ৬৮ পুলিশ সদস্য। অভিযুক্তদের মধ্যে রয়েছেÑ এসআই, সার্জেন্ট, এএসআই, নায়েক ও কনস্টেবল। অভিযুক্তদের অর্ধশতাধিক পুলিশ সদস্যই কনস্টেবল। তবে পুলিশের উচ্চ পর্যায়ে এখনও ডোপটেস্ট চালু হয়নি। পর্যায়ক্রমে পুলিশের উচ্চ পর্যায়ে ডোপটেস্ট চালু করার চিন্তা-ভাবনা রয়েছে বলে জানা গেছে।
পরিসংখ্যানে দেখা গেছে, ২০২০ সালের ১০ মার্চ থেকে ডিএমপিতে শুরু হওয়া এই ডোপ টেস্ট ২০২২ সালের জুলাই পর্যন্ত জোরেশোরে চলে। ওই বছরের আগস্ট থেকে ডোপ টেস্টে শনাক্তের সংখ্যা কমে গেছে।
এ ব্যাপারে জানতে চাইলে ডিএমপি কমিশনার খন্দকার গোলাম ফারুক বলেন, পুলিশের ডোপটেস্ট বন্ধ হয়নি। এখন সন্দেহভাজন পুলিশ সদস্যকে এই ডোপটেস্ট করা হয়। অনেকের চাকরি চলে যাওয়ায় পুলিশে মাদকাসক্তের সংখ্যা কমে গেছে। এই ডোপটেস্ট অব্যাহত থাকবে।
সমাজ বিজ্ঞানী অধ্যাপক ড. মো. আনোয়ার হোসেন বলেন, পুলিশে ডোপটেস্ট শুরু হয়েছে এবং অভিযুক্ত প্রমাণে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেয়া হচ্ছে এটি একটি শুভ লক্ষণ। তবে এটা কেন কনস্টেবল কিংবা এসআই পর্যন্ত সীমাবদ্ধ থাকবে রাষ্ট্রের কাছে এ প্রশ্ন আনা দরকার। এখানেও ক্ষমতা সবার জন্য প্রয়োগ করা হচ্ছে না বলে মনে হচ্ছে। যে পুলিশ সদস্য মাদকে জড়িত তিনি সমাজের বা দেশের কি সেবা দিবেন। সব চেয়ে বড় প্রশ্ন হলো, পুলিশ সদস্যরা কেন হতাশায় ভুগবে যে তাদের ড্রাগ নিতে হবে? তাদের দিয়ে কি অতিরিক্ত পরিশ্রম করানো হচ্ছে নাকি অন্য কিছু। শুধু ডোপটেস্ট দিয়ে এটা সমাধান করা যাবে না। এটি এখন কালচারাল, সোশ্যাল এবং পলিটিক্যাল ইস্যু। কেন তাদের মধ্যে মাদক সেবনের প্রবণতা বাড়ছেÑ তাদের সমস্যাগুলোকে চিহিৃত করতে হবে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্রিমিনোলজি বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক খন্দকার ফারজানা রহমান বলেন, পুলিশে ডোপটেস্ট একটি প্রশংসনীয় উদ্যোগ। পুলিশ মাঠে কাজ করে, মামলার তদন্ত করে। তারাই যদি মাদকে আসক্ত থাকে সেটি খুবই উদ্বেগজনক বিষয়। পুলিশের কাজ জনগণের নিরাপত্তা দেয়া, শান্তি-শৃঙ্খলা রক্ষা করা, সর্বোপরি দেশের উন্নয়নে নিয়েজিত থাকা। কিন্তু তারা নিজেরাই আইন ভঙ্গ করলে পুলিশের ইমেজ নষ্ট হবে। চাকরি করাকালীন নয়Ñ ডোপটেস্ট হওয়া উচিত চাকরিতে প্রবেশকালে।
পুলিশ সদর দফতর সূত্রে জানা গেছে, ২০১৮ সালে প্রথম পুলিশ সদস্য ও কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে মাদকাসক্ত ও ব্যবসায় জড়িত থাকার অভিযোগ তোলা হয়। এরপর মাদকাসক্ত পুলিশ সদস্যদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণের পরিকল্পনা নেয়া হয়। কিন্তু নানা প্রতিকূলতার মধ্যে শেষ পর্যন্ত চূড়ান্ত কার্যক্রম চলেনি। তবে এখন পুলিশ সদস্যদের মাদকমুক্ত করার অভিযান আরো জোরদার করার প্রস্তুতি গ্রহণ করা হয়েছে। মাদকসেবন, মাদককারবার, মাদক বাণিজ্যের সঙ্গে যে পুলিশ সদস্য বা যারাই যুক্ত থাকবেন তাদের আইনের আওতায় এনে কঠোর শাস্তির ব্যবস্থা করা হবে।