দৈনিক শিক্ষাডটকম প্রতিবেদক: ৪৬তম বিসিএসের প্রিলিমিনারি পরীক্ষা ভুল প্রশ্নে হয়েছে। ২০০ নম্বরের প্রশ্নের এই পরীক্ষায় ইংরেজি অংশে আটটি এবং গণিত অংশে তিনটি প্রশ্নে ভুল ছিল বলে অভিযোগ পাওয়া গেছে। এর মধ্যে ইংরেজি অংশের প্রশ্নের উত্তরে একাধিক শুদ্ধ উত্তর থাকায় সমস্যা আরো বেড়েছে। সব মিলিয়ে পরীক্ষার্থীরা বুঝতে পারছেন না তাদের কী হবে? পরীক্ষার্থীরা বলেছেন, স্নাতক তরুণদের মধ্যে এখন বিসিএস কর্মকর্তা হওয়া রীতিমতো স্বপ্নে পরিণত হয়েছে।
গত শুক্রবার বিসিএসের প্রিলিমিনারি পরীক্ষায় যথা সময়ে হাজির না হওয়ায় অংশ নিতে ব্যর্থ হয়ে বহু তরুণ রাস্তায় গড়াগড়ি দিয়ে রীতিমতো কান্নাকাটি করেছেন। আরো কয়েকজন তরুণ পরীক্ষায় বসতে না পেরে ক্ষোভ আর হতাশা প্রকাশ করেছেন। এরকম পরিস্থিতিতে তীব্র প্রতিযোগিতামূলক বিসিএস পরীক্ষায় ১ নম্বরের হেরফেরে অনেক কিছু ঘটে যায়। অনেক ভেবে প্রশ্নের উত্তর দিতে হয়। ভুল উত্তর দিলে নম্বর কাটা যায়। কিন্তু ভুল প্রশ্নের জন্য কী হবে? তবে পাবলিক সার্ভিস কমিশন (পিএসসি) বলেছে, ভুল প্রশ্নের জন্য কোনো পরীক্ষার্থীর ক্ষতি হবে না। প্রসঙ্গত, গত শুক্রবার ৪৬তম বিসিএসের প্রিলিমিনারি পরীক্ষা হয়। পাবলিক সার্ভিস কমিশন (পিএসসি) আয়োজিত এই পরীক্ষায় ঢাকা, চট্টগ্রাম, রাজশাহী, খুলনা, বরিশাল, সিলেট, রংপুর ও ময়মনসিংহের বিভিন্ন কেন্দ্রে চাকরি প্রার্থীরা অংশ নেন। সকাল ১০টা থেকে দুপুর ১২টা পর্যন্ত ২০০ নম্বরের এই পরীক্ষা হয়। ৪৬তম বিসিএসের প্রিলিমিনারিতে ২ লাখ ৫৪ হাজার ৫৬১ জন প্রার্থী অংশ নিয়েছেন। পরীক্ষা দেননি ৮৩ হাজার ৪২৫ জন।
উপস্থিতির হার ৭৫ শতাংশ। এই বিসিএসে ৩ হাজার ১৪০টি পদের মধ্যে সবচেয়ে বেশি নেয়া হবে স্বাস্থ্য ক্যাডারে। এছাড়া সহকারী সার্জন ১ হাজার ৬৮২ জন, সহকারী ডেন্টাল সার্জন ১৬ জন নেয়া হবে। এরপর সবচেয়ে বেশি নেয়া হবে শিক্ষা ক্যাডারে। বিভিন্ন বিষয়ে এই ক্যাডার থেকে বিসিএস শিক্ষায় ৫২০ জন নেয়া হবে। জানতে চাইলে পিএসসি চেয়ারম্যান সোহরাব হোসাইন গতকাল বলেন, ৪৬তম বিসিএসের প্রিলিমিনারি পরীক্ষার প্রশ্নে কিছু ভুলের অভিযোগ পাওয়া গেছে। আমরা বিষয়টি খতিয়ে দেখছি। তিনি বলেন, ভুল প্রশ্নের জন্য কোনো পরীক্ষার্থীর ক্ষতি হবে না। আমরা শিগগরিই বসে বিষয়টি ঠিক করে দেব। তবে তিনি এও বলেন, কোনো প্রশ্নকারী যদি সাধারণ ভুল করেন তাহলে তাকে পরবর্তীতে আর প্রশ্ন করার সুযোগ দেয়া হবে না।
প্রশ্নপত্র মডারেশনের সঙ্গে জড়িতদের ক্ষেত্রেও একই ব্যবস্থা নেয়া হবে বলে জানান তিনি। ৪৬তম বিসিএসের প্রিলিমিনারি পরীক্ষার প্রশ্নপত্র ঘেঁটে দেখা গেছে, চার সেটে পরীক্ষা হয়েছে। এর মধ্যে ২ নম্বর সেটের ইংরেজি অংশে ১ নম্বর প্রশ্নের চারটি উত্তরের মধ্যে ‘খ’ এবং ‘গ’ দুটোই শুদ্ধ। পরীক্ষার্থীরা বলেছেন, ‘খ’ এবং ‘গ’র মধ্যে কোন উত্তরটি পিএসসি ঠিক বলে ধরে নেবে; তারা তা বুঝতে পারছেন না। একই সেটের এর পরের প্রশ্নটির উত্তরেও বানান ভুল রয়েছে। ৫ নম্বর প্রশ্নে প্রদত্ত বাক্য গঠনই ত্রæটিপূর্ণ। এছাড়া প্রশ্নপত্রে দেয়া চারটি উত্তরের কোনোটিই ঠিক নয়। ১১ নম্বর প্রশ্নের সিম্পল সেন্টেন্সের ক্ষেত্রে দুটো উত্তর ঠিক। অর্থাৎ এই প্রশ্নে ‘ক’ এবং ‘খ’ দুটোই ঠিক।
পিএসসির মতে কোন উত্তরটি সঠিক হবে, প্রশ্ন শিক্ষার্থীদের। ১২ নম্বর প্রশ্নেও ‘গ’ এবং ‘ঘ’ উত্তর দুটোই সঠিক। ২২ নম্বর প্রশ্নে ‘ক’ ‘খ’ এবং ‘গ’ তিনটি উত্তর ঠিক। পিএসসি কোনটিকে সঠিক করেছে তা পরীক্ষার্থীরা জানেন না। ২৩ নম্বর প্রশ্নে পুরো বাক্যটাই ভুল। কারণ প্রশ্নে লেখা আছে গাছ থাকে রাস্তার উপরে। ২৪ নম্বর প্রশ্নের কোনো উত্তরই ঠিক নয়। ২৯ নম্বর প্রশ্নেও কোনো উত্তর ঠিক নয়। কারণ চসার নামক কবির গল্পগুলো কবিতা আকারেই লেখা। পিএসসির বেশ কয়েকজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা বলছেন, বিসিএসের প্রশ্ন তৈরির ক্ষেত্রে প্রশ্নকারীদের সতর্কতা অবলম্বন করতে বলা হয়েছে। এ বিষয়ে তাদের সঙ্গে বৈঠকও করা হয়েছে। তবুও ভুল হচ্ছে। যা মেনে নেয়ার মতো নয়। তারা বলছেন, ১২০ জন প্রশ্নকারী প্রশ্ন তৈরি করেন। সেই প্রশ্ন ১২০ জন মডারেশন করেন। এরপর প্রশ্ন ছাপানোর জন্য প্রেসে পাঠানো হয়। প্রশ্নপত্র তৈরি শেষ হওয়ার পর তা সরাসরি কেন্দ্রে পাঠিয়ে দেয়া হয়। ফলে পিএসসির কেউ প্রশ্ন দেখতে পারেন না। প্রশ্ন দেখার সুযোগ থাকলে ভুল সংশোধন করা যেত।
প্রশ্নপত্র তৈরির সঙ্গে পিএসসির কোনো সম্পৃক্ততা নেই। জানতে চাইলে ৪৬তম বিসিএসের দায়িত্বপ্রাপ্ত পিএসসির সদস্য অধ্যাপক ড. মুবিনা খোন্দকার বলেন, শুধু ইংরেজি বা গণিতের অংশ নয়, বাংলা অংশেও ভুল প্রশ্নের অভিযোগ পেয়েছি। প্রশ্নে ভুল থাকায় এখন পুরো কমিশনের বৈঠক হবে। বৈঠকেই ঠিক করা হবে, শিক্ষার্থীদের ক্ষতি কীভাবে পুষিয়ে দেয়া হবে। তার মতে, ভুল প্রশ্নের জন্য কোনো পরীক্ষার্থীর ক্ষতি হবে না। এর আগে গত শুক্রবার সারাদেশের ৮টি বিভাগীয় শহরে ৪৬তম বিসিএসের প্রিলিমিনারি পরীক্ষা অনুষ্ঠিত হয়। এরপর থেকেই সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে একাধিক প্রশ্ন ভুল বলে অভিযোগ তোলেন পরীক্ষায় অংশ নেয়া প্রার্থীরা। চাকরি প্রার্থীরা বলছেন, ৪৬তম বিসিএসের গণিত অংশে তিনটি এবং ইংরেজি অংশের দুটি প্রশ্ন নিয়ে সমস্যা ছিল।
এর মধ্যে গণিতের তিন প্রশ্নের একটি হলো- ‘১ হতে বড় ১০০০ এর মধ্যে কতগুলো সংখ্যা আছে যারা ১৬ দ্বারা বিভাজ্য নয় কিন্তু ৩০ দ্বারা বিভাজ্য’; ‘পাঁচটি ধারাবাহিক পূর্ণসংখ্যার গড় হলো ১৫, সবচেয়ে বড় পূর্ণ সংখ্যা কত? এবং ‘একটি কমিটিতে পুরুষ এবং মহিলার সংখ্যা একটি অনুপাতে ৩:২ হলে এবং মহিলা সংখ্যা ২৫ হলে পুরুষের সংখ্যা কত? এ তিনটি প্রশ্নের সঠিক উত্তর দেয়া ছিল না। দীর্ঘদিন ধরে বিসিএস নিয়ে কাজ করা নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একজন বিশেষজ্ঞ জানান, বিসিএসের প্রশ্ন তৈরির পর তা যাচাই করা হয়। এরপর প্রশ্নের মডারেশন হয়। মডারেশন করা হয় প্রশ্নে কোনো ভুল আছে কি না তা চেক করতে। অথচ সব প্রক্রিয়া মেনেও ৪৬তম বিসিএসের প্রশ্নে এত ভুল? সাংবিধানিক একটি প্রতিষ্ঠানের কাছ থেকে এমন কিছু কেউ প্রত্যাশা করে না। তিনি আরো বলেন, গণিতের একটি প্রশ্ন ছিল ‘একটি কমিটিতে পুরুষ এবং মহিলার সংখ্যা একটি অনুপাতে ৩:২ হলে এবং মহিলা সংখ্যা ২৫ হলে পুরুষের সংখ্যা কত?’ এই প্রশ্নে সঠিক উত্তর হয় ৩৭.৫। তবে মানুষ তো আর অর্ধেক হতে পারে না।
পরীক্ষার হলে অনেকেই এই প্রশ্নের উত্তর করতে গিয়ে নাকানিচুবানি খেয়েছেন। প্রশ্ন তৈরির ক্ষেত্রে পিএসসিকে আরো সতর্ক হতে হওয়ার পরামর্শ দেন তিনি। ইংরেজি প্রশ্ন নিয়ে নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক আরেকজন বিশেষজ্ঞ বলেন, ২৩ নম্বর প্রশ্নের চারটি উত্তর আছে। একটিকে শুদ্ধ বলে লিখতে হবে। কিন্তু চারটি উত্তরেই ‘অন’ লেখা হয়েছে। অথচ এটাতে ‘অন’ এর বদলে ‘বাই’ হওয়ার কথা। এভাবে ৮টি প্রশ্নে ভুল আছে। যোগ্য ও দক্ষ লোক দিয়ে প্রশ্ন প্রণয়ন করলে এই সমস্যা হতো না। তবে পিএসসির কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, বিসিএসের প্রশ্ন নিয়ে কোনো অভিযোগ থাকলে সেটি প্রাথমিকভাবে খতিয়ে দেখা হয়। প্রাথমিক তদন্তে অভিযোগের প্রমাণ পেলে একটি বিশেষজ্ঞ দল বিষয়টি খতিয়ে দেখে। বিশেষজ্ঞ কমিটি অভিযোগের সত্যতা পেলে ভুল প্রশ্নের জন্য কোনো নম্বর কাটা হয় না।
সংশ্লিষ্টরা বলেছেন, প্রতিটি বিসিএসের প্রিলিমিনারি পরীক্ষার পর পরীক্ষার্থীরা ভুল প্রশ্ন নিয়ে দ্বিধাদ্বন্ধে থাকেন। এবারো ৪৬তম বিসিএসের প্রিলিমিনারি পরীক্ষা হয় গত শুক্রবার। এরপর থেকে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুকে প্রশ্নে ভুল নিয়ে আলোচনা চলছে। প্রশ্নে ভুল থাকলে পিএসসি কী করে? এমন প্রশ্নের জবাবে পিএসসির পরীক্ষা নিয়ন্ত্রক (ক্যাডার) আনন্দ কুমার বিশ্বাস বলেন, এ ধরনের অভিযোগ এলে আমরা সেটি আমলে নিয়ে প্রাথমিকভাবে যাচাই করি। এরপর একটি বিশেষজ্ঞ দল দিয়ে তা যাচাই করাই। যদি ভুল পাই, তাহলে সেই প্রশ্নের নম্বর কাটা হয় না। সবাই নম্বর পান।
এবারো যদি এমন হয়, তাহলে সবাইকে ভুল প্রশ্নের জন্য নম্বর দেয়া হবে। সেটিতে যে অপশনেই টিক মার্ক দিক না কেন, তা দেখা হয় না। কেউ বঞ্চিত হন না। সবাই নম্বর পান।