ভবিষ্যৎ চিকিৎসকদের মন জয় করতে পারেনি অধিকাংশ বেসরকারি মেডিক্যাল কলেজ। মাত্র ১৩টি বেসরকারি মেডিক্যাল কলেজে বরাদ্দকৃত আসনে শতভাগ শিক্ষার্থী ভর্তি হয়েছে। অপেক্ষমাণ (ওয়েটিং লিস্ট) থেকে দ্বিতীয় ধাপে শিক্ষার্থী ভর্তির সুযোগ দেওয়ার পরও প্রায় এক হাজার আসন শূন্য। তৃতীয় ধাপে খুলে দেওয়া হয়েছে স্বাস্থ্য শিক্ষা অধিদপ্তরের ওয়েব পোর্টাল। তবুও আশানুরূপ সাড়া নেই।
স্বাস্থ্য শিক্ষা অধিদপ্তরের তথ্যমতে, দেশের ৬৭টি বেসরকারি মেডিক্যাল কলেজে এমবিবিএস কোর্সে দেশি-বিদেশি শিক্ষার্থীর জন্য ৬ হাজার ২৯৩টি আসন রয়েছে। এসব আসনের বিপরীতে শিক্ষার্থী ভর্তির শেষ সময় ছিল গত ১৮ এপ্রিল। কিন্তু এখনো বেসরকারি মেডিক্যাল কলেজে প্রায় এক হাজার আসন শূন্য রয়েছে। অর্থাৎ নির্দিষ্টসংখ্যক আসনে প্রয়োজনীয় শিক্ষার্থী পায়নি ৫৪টি কলেজ। এমন পরিস্থিতিতে স্বাস্থ্য শিক্ষা অধিদপ্তর বেসরকারি মেডিক্যাল কলেজে দেশি-বিদেশি শিক্ষার্থী সংকট কাটাতে ফের ভর্তির সিদ্ধান্ত নিয়েছে। এর মধ্যে গত ১৯ মে থেকে তিন সপ্তাহের জন্য বিদেশি শিক্ষার্থীদের জন্য ভর্তির আবেদনের পোর্টাল আবার খুলে দেওয়া হয়েছে। আর দেশি শিক্ষার্থীদের জন্য ২১ মে থেকে গতকাল (৮ জুন) পর্যন্ত ফের ভর্তির আবেদন করতে বলা হয়েছে।
শিক্ষার্থী সংকটের জন্য অটোমেশন ও অধিদপ্তরের অদক্ষতাকে দায়ী করছে কলেজ কর্তৃপক্ষ। তারা বলছে, আগে শিক্ষার্থীরা পছন্দমতো কলেজে ভর্তির সুযোগ পেত। কিন্তু অটোমেশন পদ্ধতির কারণে দুই বছর ধরে সেটি হচ্ছে না। এতে ভর্তিচ্ছু শিক্ষার্থী ও বেসরকারি
মেডিক্যাল কলেজ উদ্যোক্তারা ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন। বাংলাদেশ প্রাইভেট মেডিক্যাল কলেজ অ্যাসোসিয়েশনের (বিপিএমসিএ) সভাপতি এবং ইন্টারন্যাশনাল মেডিক্যাল কলেজ ও হাসপাতালের ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) এম এ মুবিন খান বলেন, অটোমেশনের কারণে বেসরকারি মেডিক্যাল শিক্ষা খাত হুমকির মুখে। মেধা তালিকার প্রথম দিকের শিক্ষার্থীরা আসছে না। কারণ তারা তাদের কাঙ্ক্ষিত মেডিক্যাল কলেজে ভর্তি হতে পারছে না। ফলে শেষের দিকের ছাত্রছাত্রী ভর্তি হচ্ছে। এমনকি গরিব বা মেধাবী ফ্রি কোটায় পর্যন্ত শিক্ষার্থী পাওয়া যাচ্ছে না।
তবে এমন অভিযোগ মানতে নারাজ অধিদপ্তরের কর্মকর্তারা। স্বাস্থ্য শিক্ষা অধিদপ্তরের পরিচালক (চিকিৎসা শিক্ষা) মো. মহিউদ্দিন মাতুব্বর বলেন, অটোমেশনের কারণে প্রকৃত মেধাবীরা ভর্তির সুযোগ পাচ্ছে; বাড়তি টাকা-পয়সা লাগছে না। মেধায় যে পিছিয়ে সে টাকা বেশি দিয়েও একটি ভালো কলেজে ভর্তি হতে পারছে না। তিনি বলেন, মানুষ অর্থনৈতিক চাপে রয়েছে। এ কারণে বেসরকারি মেডিক্যাল কলেজে শিক্ষার্থী ভর্তিতে আগ্রহ কম। মধ্যবিত্তের পক্ষে বেসরকারিতে অর্থ খরচ করে সন্তানকে পড়াশোনা করানো কঠিন ব্যাপার হয়ে দাঁড়ায়। এখানে অটোমেশন দায়ী নয়।
তবে এই বক্তব্যের সঙ্গে একমত নন মেডিক্যাল কলেজ মালিকরা। বিপিএমসিএ সভাপতি ডা. এম এ মুবিন খান বলেন, অটোমেশন মানোন্নয়নের মাপকাঠি নয়। একটি গ্রুপ পরিকল্পিতভাবে বেসরকারি খাতকে ধ্বংসের জন্য সূক্ষ্মভাবে কাজ করছে। মিথ্যা তথ্য দিয়ে ধূম্রজাল তৈরি করছে। ভর্তি প্রক্রিয়ায় কেউ নির্ধারিত ফির বাইরে আর্থিক লেনদেন করলে তাদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণসহ প্রধানমন্ত্রীর দপ্তর থেকে পুরো বিষয়টি তদন্তের দাবি জানিয়েছেন তিনি। মানোন্নয়নের জন্য স্বাস্থ্য ও পরিবারকল্যাণ মন্ত্রণালয়, স্বাস্থ্য শিক্ষা অধিদপ্তর, বাংলাদেশ মেডিক্যাল অ্যান্ড ডেন্টাল কাউন্সিল (বিএমডিসি) এবং অধিভুক্ত বিশ্ববিদ্যালয় প্রতি বছর বেসরকারি মেডিক্যাল কলেজ পরিদর্শন করে থাকে। প্রয়োজনে এই চার সংস্থাকে আরও শক্তিশালী করার কথা বলেন ডা. এম এ মুবিন খান।
এ প্রসঙ্গে স্বাস্থ্য প্রতিমন্ত্রী ডা. রোকেয়া সুলতানা বলেন, বেসরকারি খাতকে বাদ দিয়ে কিছু চাই না। কোয়ালিটি মেইনটেন করে মেডিক্যাল শিক্ষাকে চালিয়ে নিতে চাই। অনেক বেসরকারি মেডিক্যাল কলেজে পর্যাপ্ত শিক্ষক নেই; ক্লাসরুম সংকট; শিক্ষার্থী অনুপাতে হাসপাতাল শয্যাও সংকট আছে। এরপর যারা শিক্ষার্থী টানতে পারেনি তাদের কোয়ালিটি সমস্যা, অটোমেশন নয়। অটোমেশনে মেধার মূল্যায়ন হচ্ছে।
তিনি বলেন, বেসরকারি মেডিক্যাল কলেজের মালিকদের অটোমেশন একটা অজুহাত। কেউ সিরিয়ালে এগিয়ে থাকলে অবশ্যই সে ভর্তি হবে। আমরা অযোগ্য চিকিৎসক চাই না। যদি ১০ জন সলিড চিকিৎসক পড়াশোনা করে বের হন, সেটিই চাই। তারাই তো আমাদের চিকিৎসা দেবেন।
স্বাস্থ্য প্রতিমন্ত্রী আরও বলেন, স্বাস্থ্য শিক্ষা অধিদপ্তরের মহাপরিচালকে বেসরকারি মেডিক্যালল কলেজের আসন শূন্য থাকার পেছনে কারণ খুঁজে দেখার নির্দেশ দিয়েছি। সেইসঙ্গে সব বেসরকারি মেডিকেল কলেজের মান যাচাইয়েরও কথা বলেছি। আমরা মানসম্মত চিকিৎসা শিক্ষা নিশ্চিত করতে চাই।
শতভাগ আসন পূরণ ১৩ কলেজের
৬৭টি বেসরকারি মেডিক্যাল কলেজের মধ্যে এখন পর্যন্ত ১৩টি কলেজের শতভাগ আসন পূরণ হয়েছে। বাকি ৫৪ কলেজের আসন ফাঁকা রয়েছে। শতভাগ আসন পূরণ হওয়া কলেজগুলো হলো রাজধানীর আনোয়ার খান মডার্ন মেডিক্যাল কলেজ, আদ-দ্বীন উইমেন্স মেডিক্যাল কলেজ, বাংলাদেশ মেডিক্যাল কলেজ, উত্তরা আধুনিক মেডিক্যাল কলেজ, ইব্রাহিম মেডিক্যাল কলেজ, উত্তরা মেডিক্যাল কলেজ ফর উইমেন, সাভারের এনাম মেডিক্যাল কলেজ, ফরিদপুর ডায়াবেটিক অ্যাসোসিয়েশন মেডিক্যাল কলেজ, কুমিল্লা ময়নামতি মেডিক্যাল কলেজ, রাজশাহী ইসলামী ব্যাংক মেডিক্যাল কলেজ, সিলেট জালালাবাদ রাগিব রাবেয়া মেডিক্যাল কলেজ, চট্টগ্রাম মা ও শিশু হসপিটাল মেডিকেল কলেজ এবং চট্টগ্রাম মেরিন সিটি মেডিক্যাল কলেজ।
১০ আসন পর্যন্ত ফাঁকা ১৬ কলেজে
মোট আসনের মধ্যে ১ থেকে ১০টি আসন ফাঁকা রয়েছে ১৬টি মেডিক্যাল কলেজে। কলেজগুলো হলো রাজধানীর হলি ফ্যামিলি রেডক্রিসেন্ট মেডিক্যাল কলেজ, কিশোরগঞ্জ জহুরুল ইসলাম মেডিকেল কলেজ এবং ইবনে সিনা মেডিকেল কলেজে একটি করে আসন শূন্য রয়েছে। কুমিল্লা সেন্ট্রাল মেডিকেল কলেজ এবং চট্টগ্রাম ইন্টারন্যাশনাল মেডিকেল কলেজ, ধানমন্ডি গ্রিন লাইফ মেডিক্যাল কলেজ দুটি করে আসন ফাঁকা রয়েছে। ডা. সিরাজুল ইসলাম মেডিকেল কলেজ এবং খুলনা সিটি মেডিকেল কলেজে চারটি করে আসন শূন্য রয়েছে। টাঙ্গাইল কুমুদিনী মেডিক্যাল কলেজে পাঁচটি, রাজধানীর ইউনিভার্সাল মেডিক্যাল কলেজে ছয়টি, মানিকগঞ্জ মুন্নু মেডিকেল কলেজে সাতটি, ঢাকার সমাজভিত্তিক মেডিক্যাল কলেজ, ঢাকা সেন্ট্রাল ইন্টারন্যাশনাল মেডিক্যাল কলেজ এবং খুলনা গাজী মেডিকেল কলেজে আটটি করে আসন ফাঁকা রয়েছে। রাজধানীর পুরান ঢাকার আসগর আলী মেডিক্যাল কলেজ এবং চট্টগ্রাম সাউদার্ন মেডিক্যাল কলেজ ১০টি করে আসন ফাঁকা রয়েছে।
২০ আসনের বেশি ফাঁকা ২০ কলেজে
১০৫ আসনের ধানমন্ডি পপুলার মেডিক্যাল কলেজে ফাঁকা ৪৯ আসন। ৮০ আসনের গাজীপুর সিটি মেডিক্যাল কলেজে ফাঁকা ৪৮ আসন। ১০৫ আসনের রাজশাহীর বরেন্দ্র মেডিক্যাল কলেজে ফাঁকা ৩৮ আসন। ১০০ আসনের চট্টগ্রাম বিজিসি ট্রাস্ট মেডিক্যাল কলেজে ফাঁকা ৩৬ আসন। ১৩০ আসনের ঢাকা ন্যাশনাল মেডিক্যাল কলেজে ফাঁকা ৩৫ আসন। ৫০ আসনের মনোয়ারা সিকদার মেডিক্যাল কলেজে ফাঁকা ৩৬৫ আসন। ৭০ আসনের রাজধানীর মার্কস মেডিক্যাল কলেজে ফাঁকা ২০ আসন। ১১৫ আসনের এমএইচ মেডিক্যাল কলেজে ২৫; ৮৫ আসনের সিরাজগঞ্জ নর্থ বেঙ্গল মেডিক্যাল কলেজে ২২টি; ৮২ আসনের সিলেট পার্কভিউ মেডিকেল কলেজে ২৫; ৯৫ আসনের কিশোরগঞ্জ প্রেসিডেন্ট আব্দুল হামিদ মেডিক্যাল কলেজে ২৬; ১৩৫ আসনের রংপুর কমিউনিটি মেডিকেল কলেজে ২৪; ৯০ আসনের গুলশান শাহাবুদ্দিন মেডিক্যাল কলেজে ২৬; ১৪০ আসনের শহীদ মনসুর আলী মেডিকেল কলেজে ২০; ৫০ আসনের আহছানিয়া মিশন মেডিক্যাল কলেজে ২০; ৫০ আসনের আশিয়ান মেডিকেল কলেজে ২৬; ৫৭ আসনের মুন্সীগঞ্জ বিক্রমপুর ভূঁইয়া মেডিক্যাল কলেজে ২২; ৬০ আসনের ব্রাহ্মণবাড়িয়া মেডিক্যাল কলেজে ২২; ১৪০ আসনের ময়মনসিংহ কমিউনিটি বেইজডমেডিক্যালকলেজে ৩১; ৮০ আসনের চট্টগ্রামের ইনস্টিটিউট অব অ্যাপ্লাইড হেলথ সায়েন্সে ২৭টি আসন ফাঁকা রয়েছে। এ ছাড়া ১১ থেকে ১৯টি আসন ফাঁকা রয়েছে বাকি ১৮টি বেসরকারি মেডিক্যাল কলেজে।