‘প্রতি মাসে জাতীয় রাজস্ব বোর্ডকে (এনবিআর) নানান কাজের জন্য ১৫ থেকে ২০ লাখ টাকা ঘুষ দিতে হয়। এখন এনবিআর কর্মকর্তারা যদি বলেন কাল থেকে ঘুষ নেওয়া বন্ধ করে দেবেন, তাহলে আগামীকাল থেকেই আমরা শ্রমিকদের বেতন বাড়িয়ে দেব।’ সম্প্রতি বেতন বৃদ্ধির দাবিতে পোশাকশ্রমিকদের আন্দোলনের পরিপ্রেক্ষিতে গতকাল বুধবার পোশাক মালিকদের সংগঠন বিজিএমইএর আলোচনা সভায় এ ভাষায় ক্ষোভ ঝাড়েন আটলান্টিক পোশাক কারখানার মালিক জহির উদ্দিন স্বপন। সভায় উপস্থিত ছিলেন বিজিএমইএ সভাপতি ফারুক হাসান, সাবেক সভাপতি শফিউল ইসলাম মহিউদ্দিন, আবদুস সালাম মুর্শেদী, একে আজাদসহ অন্য নেতারা।
বিজিএমইএ সভাপতি ফারুক হাসান বলেছেন, ‘আমাদের ফ্যাক্টরিগুলোতে ভাঙচুর করছে। এখন যেটি হচ্ছে বেতন নিয়ে, কিন্তু আমরা শ্রম আইন অনুযায়ী বেতন দিচ্ছি।
সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে অপপ্রচার চালিয়ে আন্দোলনের উসকানি দেওয়া হচ্ছে জানিয়ে এই ব্যবসায়ী নেতা বলেন, সেখানে অপপ্রচার চালিয়ে ফ্যাক্টরিগুলোতে ভাঙচুর চালানো হচ্ছে। যেসব শ্রমিক নেতা ভাঙচুরে নেতৃত্ব দিয়েছে, তাদের দ্রুত গ্রেপ্তারের দাবি জানাচ্ছি।’ শতাধিকা পোশাক কারখানা বন্ধ হয়েছে জানিয়ে তিনি বলেন, ‘আমরা বারবার বলেছি, সরকার মজুরি কাঠামো নিয়ে যে ঘোষণা দেবে, সেটিই আমরা মেনে নেব। সেটির বাস্তবায়ন ডিসেম্বরের শুরু থেকে। এখন যা হচ্ছে এটি ন্যায়সংগত আন্দোলন হতে পারে না। কারখানায় আগুন দেওয়ার কারণে একজন শ্রমিক মারা গেছেন, সে জন্য কি মালিকেরা দায়ী? নিরাপত্তার কারণে যে কারখানায় কাজ করা যাবে না, সেই কারখানা বন্ধ করে দেওয়া হবে।’
শ্রমিক সংগঠনগুলোর সঙ্গে বসে আলোচনা হয়েছে জানিয়ে ফারুক হাসান বলেন, ‘আমরা প্রতিটি শ্রমিক সংগঠনের সঙ্গে বসেছি। তারা জানিয়েছে শ্রমিকরা কেউ ভাঙচুরের সঙ্গে জড়িত নয়। এখন সারা বিশে^ অর্থনৈতিক পরিস্থিতি খারাপ। ২০২৩ খ্রিষ্টাব্দে সব দেশেই নেতিবাচক প্রবৃদ্ধি।’
এ সময় সাবেক বিজিএমইএ সভাপতি এ কে আজাদ বলেন, ‘আমাদের অনন্ত গার্মেন্টস পুড়িয়ে দেওয়া হয়েছে। যারা পুড়িয়েছে সবগুলোর ভিডিও ফুটেজ আছে। যারা আগুনে পুড়িয়ে শ্রমিক হত্যা করেছে, তাদের বিরুদ্ধে খুনের মামলা হওয়া উচিত।’
পি কে হালদারদের মতো ঋণখেলাপিদের এ পরিস্থিতির জন্য দায়ী করে সাবেক বিজিএমইএ সভাপতি শফিউল ইসলাম মহিউদ্দিন বলেন, ‘এই পরিস্থিতি আজকের এক দিনের জন্য না। আমাদের খেলাপি ঋণ, মূল্যস্ফীতি ইত্যাদি কারণে আজকের এই পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে। কভিডের কারণে ৩ বিলিয়ন ডলারের অর্ডার বাতিল হয়ে গেছে।’
বর্তমান রাজনৈতিক অবনমনকে দায়ী করে তিনি বলেন, আজকের রাজনৈতিক পরিস্থিতি কতটা খারাপ হলে এ অবস্থায় যেতে হয়েছে। এই সরকারের সাফল্য ছিল মূল্যস্ফীতি, কিন্তু খেলাপি ঋণের কারণে, আর পি কে হালদারের মতো পাচারকারীদের কারণে আজকের অর্থনীতির এ খারাপ অবস্থা। তিনি বলেন, ‘আমাদের জানমালের নিরাপত্তা দিতে হবে। যখন একটি কারখানা পুড়িয়ে দেওয়া হয়, তখন রাবার বুলেট ছোড়া ছাড়া উপায় থাকে না।’
আটলান্টিক কারখানার মালিক জহির উদ্দিন স্বপন সরকারের অন্য প্রতিষ্ঠানগুলোর ওপর ক্ষোভ ঝাড়েন। স্বপন বলেন, ‘শুধু এনবিআরই নয়, সরকারের কোনো প্রতিষ্ঠানেই টাকা ছাড়া কাজ হয় না। আমাদের দাবি হলো, কাস্টমসের হয়রানি থেকে মুক্তির জন্য বিজিএমইএ ভবনে তাদের অফিস খুলতে হবে, বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের সাব অফিস এখানে খুলতে হবে। আমরা প্যারালাল গভর্নমেন্ট, আমরা কেন তাদের কাছে নাকে খত দিতে যাব?’
তিনি বলেন, ‘অনেকেই জানেন না আমরা পোশাক ব্যবসায়ীরা প্যারালাল গভর্নমেন্ট। সরকার অনেক ক্ষেত্রে চাকরি দিতে পারে না। আমরা চাকরি দিই।’ সরকারের সচিবদের উদ্দেশে এই ব্যবসায়ী বলেন, ‘সচিব, তুমি এসি রুমে বসে বড় বড় কথা বলো, আগে দুই হাজার শ্রমিকের একটা গার্মেন্টস চালাও, তারপর দেখি তোমার শক্তি কোথায়। তোমার কথার জোর কীভাবে আসে।’
এ সময় আরেক ব্যবসায়ী নেতা তুসুকা গার্মেন্টসের মালিক আরশাদ জামাল দীপু বলেন, ‘তথাকথিত সিভিল সোসাইটি এই মুহূর্তে আমাদের কোনো সহযোগিতা করছে না। চলমান আন্দোলনে রাজনৈতিক ট্যাগ আছে। “নো ওয়ার্ক নো পে” সেøাগান এই মুহূর্তে না দেওয়াই ভালো। ২০১৮ খ্রিষ্টাব্দের পর থেকে আমাদের ইউটিলিটি ব্যয় ১৮০ শতাংশের বেশি বেড়েছে।’
বিজিএমইএর সিনিয়র সহসভাপতি এসএম মান্নান কচি বলেন, ‘আজ শ্রমিকদের নিয়ে যে বিভ্রান্তি ছড়ানো হচ্ছে তাদের শ্রমমন্ত্রীকে সেগুলো ক্লিয়ার করতে বলেছি। কামরুল নামের এক শ্রমিক নেতা এটা শুরু করেছেন। আর আমাদের শ্রমিকরা কখনো হেলমেট পরে না। শ্রমিকদের আন্দোলনে হেলমেট পরা এরা কারা।’ তিনি বলেন, ‘এই আন্দোলনের নেপথ্যে প্ররোচনা দিচ্ছে দেশি-বিদেশি বিভিন্ন চক্র। আমরা আমাদের জানমালের নিরাপত্তা চাই। আমাদের শ্রমিকদের নিরাপত্তা ও কারখানার নিরাপত্তা চাই।’