প্রাথমিক বিদ্যালয় থেকে কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয় পর্যন্ত শত শত বই পড়া হয়। কিন্তু এসব পড়ালেখার মনে থাকে খুব সামান্যই! ‘করে শেখা’ বা হাতে-কলমে কাজের মাধ্যমে কিংবা গভীর মনোযোগ দিয়ে পড়ার ফলে নিজের মগজে যেটা গেঁথে যায় সেটিই কেবল স্থায়ীভাবে মনে থাকে। আমাদের দেশে পরীক্ষার কয়েকদিন আগে পড়ে পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করার একটা পুরোনো রীতি রয়েছে। এই রীতিতে ভালো ফলাফলও পাওয়া যাচ্ছে! তাতে করে সার্টিফিকেট অর্জন হচ্ছে বটে কিন্তু কাজের কাজ হচ্ছে না। আর হচ্ছে না বলেই লাখ লাখ শিক্ষার্থী অনার্স পাস করেও বেকার। এমন শিক্ষাব্যবস্থা দরকার যে পদ্ধতিতে একজন শিক্ষার্থী এসএসসি কিংবা এইচএসসি পাস করেও নিজে উদ্যোক্তা হতে পারে বা কর্মসংস্থানের মাধ্যমে নিজের পায়ে দাঁড়াতে পারে।
ছোট পেশা হলেও সৎভাবে কর্ম করা অতি বেশি সম্মানের। তবে এটাও ঠিক, একটি দেশে শ্রমের মর্যাদা পাওয়া বা দেওয়ার রীতিনীতি গড়ে না উঠলে সেটা ভিন্ন কথা! বিশ্ববিদ্যালয় পড়ালেখা শেষে যদি লক্ষ লক্ষ শিক্ষার্থী বেকার থাকে তাহলে বুঝতে হবে সে দেশের শিক্ষাব্যবস্থায় গলদ আছে! বিশ্ববিদ্যালয় পর্যন্ত একজন শিক্ষার্থীকে পড়াতে শিক্ষার্থীর পেছনে রাষ্ট্রের অনেক অর্থ বিনিয়োগ করতে হয়। কিন্তু সেই বিশ্ববিদ্যালয় পড়ুয়া শিক্ষার্থী যদি পড়ালেখা শেষ করে বেকার থাকে তাহলে রাষ্ট্রের অর্থের অপচয় হয়। একটি দেশে সবাইকে ঢালাওভাবে বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সুযোগ দেয়ার দরকারও পড়ে না। উন্নত দেশে সব শিক্ষার্থীর বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সুযোগ থাকে না। বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন শিক্ষার্থী মানে তিনি দেশের সম্পদ, দেশের গবেষক। কিন্তু আমাদের দেশে বিশ্ববিদ্যালয় পাস করে অর্ধেকের বেশি শিক্ষার্থী মনের মতো কাজ পান না।
এতো কথা বলার অর্থ হলো, শিখন যদি স্থায়ী না হয় তাহলে তা শিক্ষার্থীর জন্য বিরূপ ফল বয়ে আনে। নতুন কারিকুলামে পরীক্ষার আগে পড়ে পাস করার বা উত্তীর্ণ হওয়ার সুযোগ নেই! প্রতিটি বিষয়ের অভিজ্ঞতা বা অধ্যায় শেষে হাতে-কলমে কাজের মাধ্যমে শিক্ষার্থীর শিখনকালীন বা ধারাবাহিক মূল্যায়নের মুখোমুখি হতে হচ্ছে। বিদ্যালয়ে প্রতিটি দিন শিক্ষার্থীকে সক্রিয় থাকতে হচ্ছে। নতুন কারিকুলাম শিক্ষার্থীদের কাজের বুয়া বানিয়ে দিবে-সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে অনেককে ট্রল করে এমনটা বলতে দেখেছি! মনে রাখা দরকার, বাসাবাড়িতে বুয়ার কাজ করাও সম্মানজনক। দেশ সেরা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে শিক্ষা নিয়ে কোট-টাই পরে ঘুষ-দুর্নীতি করে দেশের ক্ষতি করার চেয়ে সৎভাবে কম আয় করাও সম্মানের। নতুন কারিকুলামে পড়ালেখার মাধ্যমে নিজের কাজ নিজে করার শিক্ষা আছে। ‘সা রে গা মা পা ধা নি’ তথা গান গাওয়ার শিক্ষাটা যদি বিদ্যালয় থেকে হয় ক্ষতি কী। হয়তো বিদ্যালয়ে শিক্ষার্থী দক্ষ হবে না তবে মৌলিক শিক্ষা তো পাবে। শিক্ষার্থীর সম্পূর্ণ জীবন গঠনে বিদ্যালয় থেকে যা যা করতে হয় সবকিছু করা দরকার। বিভিন্ন উন্নত দেশের কারিকুলামে শিক্ষার্থীকে রাজমিস্ত্রী, ওয়েল্ডিং, সাঁতার, ছোটখাটো ইলেকট্রনিক্সসহ বিভিন্ন কাজও শেখানো হয়। প্রাক-প্রাথমিক পর্যায় থকে আমাদের দেশের শিক্ষার্থীদের ট্রাফিক নিয়ম-কানুন শেখানো হয়। কিন্তু বাস্তবিক পক্ষে বহু প্রাপ্তবয়স্ক শিক্ষার্থীর মাঝেও ট্রাফিক নিয়ম-কানুন মানতে দেখা যায় না। ফুটপাত দিয়ে হাঁটা, রাস্তা পারাপারের সময় মোবাইল ফোনে কথা না বলা, ফুটওভারব্রিজ ব্যবহার করা, ডানে-বামে দেখে রাস্তা পার হওয়ার মতো সাধারণ নিয়মগুলো অনেকে জানি না! তাহলে এমন সব নিয়ম বিদ্যালয় পর্যায়ে হাতে-কলমে শেখালে ক্ষতি কী?
নিত্যনতুন প্রযুক্তির ছোঁয়ায় বদলে যাচ্ছে চারপাশ। বদলে যাচ্ছে জীবন ও জীবিকা। এইচএসসি পাস করা শিক্ষার্থী এখন ঘরে বসে ফ্রিল্যান্সিং-এর মাধ্যমে মাসে লাখ লাখ টাকা ইনকাম করছে। নিজে উদ্যোক্তা হয়ে অন্যদের কর্মসংস্থানের সুযোগ করে দিচ্ছে। একবিংশ শতাব্দীর শুরুতে কিংবা তারও আগে গ্রামের যে শিক্ষার্থী রাস্তায় দূর থেকে শিক্ষককে দেখে ভয়ে পালিয়ে যেতো কিংবা যাওয়ার জন্য শিক্ষকের অনুমতির অপেক্ষায় থাকতো সেটা এখন আর চোখে পড়ে না। মানুষের আচার-আচরণের ধরন বদলাচ্ছে। শিক্ষক মানেই এখন সহায়তাকারী ও বন্ধু। অল্প লেখাপড়া জেনেও ইউটিউবিং, ফেসবুক মার্কেটিং, গ্রাফিক্স ডিজাইন, ভিডিও এডিটিং-এর কাজ শিখে চাকরির চেয়ে ভালো ইনকাম করা যাচ্ছে। সহজ কথায়, পরিবর্তনকে মানিয়ে নিতে হবে। যুগের সঙ্গে তাল মিলিয়ে চলতে হবে। এমন কোনো সেক্টর নেই যেখানে তথ্য-প্রযুক্তির ছোঁয়া নেই। সময়টা প্রোগ্রামিংয়ের, সময়টা রোবোটিক্সের, সময়টা কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার, সময়টা এগিয়ে যাওয়ার। সুতরাং শুধু মুখস্থ বিদ্যা দিয়ে লাভ হবে না। যোগ্যতা থাকতে হবে। দক্ষ হতে হবে। একবিংশ শতাব্দীর বৈশ্বিক চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করতে হলে কাউকে বাদ দিয়ে নয়, সবাইকে নিয়ে এগিয়ে যেতে হবে। তবে সবাইকে বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়তে হবে বা উচ্চ শিক্ষা নিতে হবে বিষয়টা এমন নয়! মূলত বিষয়টা হলো যোগ্যতা ও দক্ষতার। কম লেখাপড়া জেনেও আইসিটি জ্ঞানে দক্ষ হলেও নিজে উদ্যোক্তা হয়ে অন্যদের পথ দেখাচ্ছে অনেকে। নতুন কারিকুলামে শিক্ষার্থীদের সে পথে এগিয়ে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে। কারিকুলাম নিয়ে অনেক আলোচনা-পর্যালোচনা হচ্ছে! তবে কারিকুলামে ছোটখাটো সংশোধন থাকলে সেটা অবশ্যই সংশোধন করেই এগিয়ে যেতে হবে।
নতুন শিক্ষাক্রমে একক কাজ, দলীয় কাজ, অনুসন্ধানী কাজ, মাঠ পরিদর্শনের মতো হাতে-কলমে কাজের ব্যাপক সুযোগ রাখা হয়েছে। শিখনকালীন মূল্যায়নে ১২টিরও বেশি কাজ রাখা হয়েছে। যেমন-প্রকল্প, অ্যাসাইনমেন্ট, খেলাধুলা, কুইজ, পোস্টার প্রদর্শন, প্রতিবেদন, মডেল, সতীর্থ মূল্যায়ন, স্বমূল্যায়ন, শিক্ষক মূল্যায়ন, অংশীজন মূল্যায়ন ইত্যাদি। আগে গণিতে বেশিরভাগ শিক্ষার্থী সূত্র মুখস্থ করতো! এখন সূত্রটি কীভাবে এলো তা কাগজ কেটে করছে শিক্ষার্থীরা। বিজ্ঞান বিষয়ে মাঠে গিয়ে কৃষকের সঙ্গে কথা বলতে হচ্ছে, কৃষিকাজ করতে হচ্ছে। গাছ লাগাতে হচ্ছে। ধাপে ধাপে সব শিক্ষার্থীকে দলীয় কাজ উপস্থাপন করতে হচ্ছে। দুর্বলরা যে নিজেকে গুটিয়ে রাখবে সে সুযোগ নেই।
নতুন কারিকুলামে এমন অনেক কিছু যুক্ত করা হয়েছে যা আগে কখনো ছিল না। বৈজ্ঞানিক অনুসন্ধানের ধাপ অনুসরণ করে অনুসন্ধান কাজ পরিচালনা, সতীর্থ মূল্যায়ন, শ্রেণিকক্ষের বাইরে হাতে-কলমে কাজ, অংশীজনের অংশগ্রহণ, মূল্যায়ন প্রক্রিয়া-এমন অনেক কিছুই যুক্ত করা হয়েছে। মূলত নতুন কারিকুলামে শিক্ষার্থী অভিজ্ঞতার মধ্য দিয়ে পরিকল্পনা প্রণয়ন করে বিভিন্ন কাজের মধ্য দিয়ে তথা সমস্যা সমাধানের মাধ্যমে নিজস্ব সিদ্ধান্তে উপনীত হবে। শিক্ষাক্রমে মুখস্থ বিদ্যাকে নিরুৎসাহিত করা হয়েছে। জ্ঞান, দক্ষতা, দৃষ্টিভঙ্গি ও মূল্যবোধের সমন্বয়ে যোগ্যতা অর্জনে গুরুত্বারোপ করা হয়েছে। বর্তমান শিক্ষাক্রমে করে শেখা বা হাতে-কলমে কাজের মাধ্যমে শিক্ষার্থীর শিখন স্থায়ী হচ্ছে। সেদিন বেশি দূরে যেদিন হাতে-কলমে কাজের মধ্য দিয়ে শিক্ষার্থী যোগ্যতাসম্পন্ন দক্ষ বিশ্বনাগরিক হয়ে উঠবে।
লেখক: শিক্ষক, লৌহজং বালিকা পাইলট উচ্চ বিদ্যালয়, মুন্সীগঞ্জ
শিক্ষার সব খবর সবার আগে জানতে দৈনিক শিক্ষার ইউটিউব চ্যানেলের সাথেই থাকুন। ভিডিওগুলো মিস করতে না চাইলে এখনই দৈনিক শিক্ষাডটকমের ইউটিউব চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন এবং বেল বাটন ক্লিক করুন। বেল বাটন ক্লিক করার ফলে আপনার স্মার্ট ফোন বা কম্পিউটারে সয়ংক্রিয়ভাবে ভিডিওগুলোর নোটিফিকেশন পৌঁছে যাবে।
দৈনিক শিক্ষাডটকমের ইউটিউব চ্যানেল SUBSCRIBE করতে ক্লিক করুন।